স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

আমরা প্রায় সবাই ক্যান্সার শব্দটি শোনার সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে উঠি এবং নিশ্চিত মৃত্যু বলে মনে করে থাকি। আপনারা অনেকেই হয়তো জানেননা যে, স্তন ক্যান্সারে নারীদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ঘাতক ব্যাধি গুলোর মধ্যে স্তন ক্যান্সার বেশি মারাত্মক ও ভয়াবহ। ক্যান্সারজনিত কারণে সারা বিশ্বে স্তন ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়। আর নবজাতকের সুস্থতা বেশির ভাগ নির্ভর করে মায়ের সুস্থতার ওপর। কথায় বলে, শিশুর হাসি মায়ের খুশি। শিশুদের সুস্থতার লক্ষণ সব সময় হাসিখুশি থাকা। আর এই সুন্দর হাসিটির কারণে যখন শিশুর ঝকঝকে ছোট ছোট সাদা একরাশ দাঁত দেখা যায়, তখন সবার চোখে শিশুর অনাবিল সৌন্দর্যভরা হাসিমাখা মুখ দেখে মুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় পরিবারে।
শিশুর এ নির্মম হাসির জন্য তার সুস্থতা নিশ্চিত করা মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশেষ করে শিশুর শরীরের যথাযথ পুষ্টির জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই; কিন্তু যদি মায়ের স্তনে প্রদত্ত শিশুর জন্য মহান আল্লাহর সেই মহাদান ও নেয়ামত কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হলে, তখন শিশুর দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা বা সমস্যা হচ্ছে ব্রেস্ট টিউমার ও স্তন ক্যান্সার। গবেষণা করে ব্রেস্ট ক্যান্সারের মূল কারণ ও রহস্য আবিষ্কার করতে কোনো চিকিৎসক ও গবেষক সক্ষম হননি। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আসল কারণ চিহ্নিত করতে।
ইদানীং সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্রেস্ট টিউমার ও স্তন ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের দেশের মা-বোনদের ভাবিয়ে তুলছে। ভারত ও উপমহাদেশে প্রতি বছর ৮০ থেকে এক লাখ মহিলা ব্রেস্ট টিউমার ও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন।
যথাসময়ে রোগ নির্ণয় করতে পারলে আধুনিক হোমিও চিকিৎসার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারকে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আয়ত্তের মধ্যে আনা সম্ভব। সাধারণত এ রোগ চল্লিশার্ধে মহিলাদের বেশি দেখা যায়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে পুরুষেরও এ সমস্যা দেখা যায়। নিঃসন্তান মহিলা বা যে মহিলারা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান না বা খাওয়াতে অক্ষম তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া অল্প বয়সে মিন্সট্রেশন হওয়া, বেশি বয়সে মেনোপজে গেলে, ধূমপান করলে, শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমলেও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কথা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটা জেনেটিক ভিত্তি আছে। পরিবারের কোনো মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তাদের মা, বোন অথবা মেয়ের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। এ পর্যন্ত আটটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের জিন আবিষ্কৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য BRCA-1 & BRCA-2
স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সার কী?
স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সার এক ধরনের ঘাতক ব্যাধি, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। স্তন বা ব্রেস্টের সেল বা টিস্যুর স্বাভাবিক অবস্থার বিকৃতি ঘটিয়ে দেয়াকে ক্যান্সার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ :
স্তন ক্যান্সারের রোগীরা সাধারণত বুকে চাকা অথবা গাটের মতো অনুভব করেন। অনেক ক্ষেত্রে নিপল থেকে লাল রঙের রস অথবা রক্ত জাতীয় পদার্থ বের হয়। এ জাতীয় সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন অনেক মহিলা। স্তনের ওপরের চামড়ার রঙ ও নিপলের আকার পরিবর্তন, স্তনের চামড়া কমলালেবুর মতো কুঁচকে যায়। অনেক মহিলা স্তনে বা ব্রেস্টে এই উপসর্গগুলো অনুভব করেন; কিন্তু ভয়ে ও লজ্জায় চিকিৎসকের কাছে যান না, তাদের ক্ষেত্রে বগলের নিচে চাকা বা স্তনের ওপরের চামড়ায় কোঁচকানো লক্ষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে বুঝে নিতে হয় যে, রোগটা অনেক দূর এগিয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রাথমিক অবস্থায় স্তন টিউমার ও ক্যান্সার ধরা পড়লে ৮০-৮৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য করা সম্ভব।
কখন নিজেকে পরীক্ষা করবেন?
স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয়ের জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি হলো নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা (Breast Self Examination) আর টিউমার ও ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে এবং রোগীর চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। আমাদের দেশের চল্লিশোর্ধ মহিলারা বেশি সমস্যায় পড়েন, বিশেষত যাদের পরিবারে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী আছে, তাদের উচিত নিয়মিত Mammogram করানো। যার ফলে ব্রেস্টে গাট হওয়ার অনেক আগেই ক্যান্সার নির্ণয় করে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসায় রোগী আরোগ্য লাভ করে। নিজেকে পরীক্ষা করার আগে যেটা মনে রাখতে হবে, মাসিক বা ঋতুচক্রের সময়ে স্তনের গঠন ও আকৃতির পরিবর্তন হয়ে থাকে। যাদের মাসিক বা ঋতুচক্র নিয়মিত তাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের কয়েক দিন আগে বুকের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে বগলের কাছে সামান্য ফোলা ও ব্যথা অনুভব হয়।
কিভাবে স্তন পরীক্ষা করবেন?
  • যেসব মহিলার বয়স ২০-৩০ তারা প্রতি মাসে একবার মাসিক বা ঋতুস্রাবের এক সপ্তাহ পরে, সাধারণত গোছল করার সময় বা পোশাক পরিধান করার সময় এই পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। যাদের বয়স ৪০-৫০ বছর তারা প্রতি তিন বছর পর চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করবেন স্তনে কোনো অসামঞ্জস্য দেখা দিলে।
  • আয়নার সামনে দুই পাশে হাত রেখে দাঁড়ান। দুই দিকের স্তনের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্য আছে কি না খেয়াল করুন। এবার দুই হাত ওপরে তুলুন-মাথার দুই পাশে রাখুন। দেখুন দুই দিকে কোনো অসামঞ্জস্য আছে কি না?
  • হাতের চেটো দিয়ে প্রথমে এক দিকের স্তন ও পরে অন্য দিকের স্তন পরীক্ষা করুন। কোনো প্রকার চাকা বা ফোলা আছে কি না খেয়াল করুন।
  • এবার দেখুন নিপলের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না? যদি দেখা যায় একটি নিপল ভেতরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে বা নিপলের চার পাশে কোনো ফুসকুড়ি বা ঘা খেয়াল করা যাচ্ছে তাহলে সত্ত্বর চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
  • স্তনের বোঁটা বা নিপল থেকে কোনো প্রকার রক্ত বা রসজাতীয় পদার্থ বের হচ্ছে এমন খেয়াল করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সহজেই স্তনে চাকা বা গুটলি বা বহুমূলে স্তন ব্যথা অনুভব হয়।
ল্যাবরেটরির পরীক্ষা :
মেমোগ্রাফি, এমআরআই, গজ ও আলট্রাসনোগ্রাফি, বায়োএফসি, লিম্ফনোডস বায়োএফসি, ক্যান্সার মারকার ইত্যাদি পরীক্ষার দরকার হতে পারে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
যদিও বলা হয় স্তন ক্যান্সার বংশগত বা পারিবারিক ইতিহাস ও জিনের প্রভাব থেকে রোগীকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। বংশগত কারণ ছাড়াও স্তন টিউমার ও ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারে তবে ভালো পুষ্টিকর খাদ্য এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। অনেক রোগী অপারেশন করেও আশানুরূপ ফল পাননি। এমনো রোগী আছেন যারা দুই-তিনবার অপারেশন করার পর আবার তাদের ব্রেস্ট টিউমার বা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। ভুক্তভোগীদের মনে রাখতে হবে অপারেশন করে কেটে বাদ দিলেই রোগ চলে যায় না। অনেকে মনে করে কেটে বাদ দিলে রোগ চলে যাবে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, কারণ পয়জন আক্রমণ করে ব্যক্তির শরীরে, রক্ত ও মাংসের মধ্যে। পয়জন দূর করতে হলে মেডিসিনের বিকল্প নেই। অপারেশন ছাড়া হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্রেস্ট টিউমার ও ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্তকে সুন্দরভাবে আরোগ্য করা সম্ভব। লক্ষণসাদৃশ্য সঠিক ওষুধ নির্বাচন করা হলে সহজে আরোগ্য সম্ভব। রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, রোগের কারণ, দুঃখ-কষ্ট, মানসিক চাপ বিবেচনা করে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।

Leave a Reply