সিরোসিস বা লিভার সিরোসিস নামক রোগটির কথা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু জন্ডিস কথাটি শুনলে আমরা যতটা বিচলিত হই, লিভার সিরোসিস কথাটি আমাদের ঠিক ততটা বিচলিত করে না। অথচ বিশ্বব্যাপী অন্ততঃ পঞ্চাশ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এই রোগে লিভার তথা যকৃতের শেষ পর্যায়ের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের কারণে এর স্বাভাবিক কাঠামো স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়। ফলে এর কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে লিভার দুর্বলতা জনিত জটিলতায় রোগী মৃত্যুর কোলে ঢেলে পড়ে। লিভারের নিস্ক্রিয়তা, লিভার ক্যান্সার ও লিভার জনিত মৃত্যুর অন্যতম কারণ হল এই সিরোসিস।
সিরোসিস শব্দটি প্রথম বর্ননা করেন বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানী ডাঃ রিনে লেনেক (Rene Laennec) ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে । শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ কিরাস (Kirrhos) থেকে। যার শাব্দিক অর্থ তামাটে হলুদ অমসৃন রঙ যা লিভারের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহে রোগীর শরীরে দেখা যায়।
আমরা জানি যকৃত বা লিভার হল মানুষের শরীরের একটি অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। পিত্ত নিঃসরণের মাধ্যমে খাবার হজম হতে শুরু করে শরীরের যাবতীয় বিপাকীয় কার্যাবলী এর দ্বারা সম্পাদিত হয়। ফলে লিভারের অসুস্থতার ফলাফল হয় ব্যাপক ও ভয়াবহ। অনেক রকম কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে। তবে কারণ যাই হোক নূন্যতম ছয় মাসব্যাপী প্রদাহ না হলে লিভার এর স্বাভাবিক কাঠামোর পরিবর্তন হয় না। লিভার সিরোরিস হতে সময় লাগে কমপক্ষে ৪-১০ বত্সর। বাংলাদেশে সিরোসিস এর প্রধান কারণ শরীরে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের সংক্রমণ।
এছাড়া আরও কারণ রয়েছে :-
- হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস সংক্রমণ।
- লিভারের অতিরিক্ত চর্বি।
- অতিরিক্ত মদ্যপান।
- ইমিউনোলজিক্যাল রোগ: অটোইমিউন লিভার ডিজিজ।
- প্রাইমারী বিলিয়ারী সিরোসিস।
- জেনেটিক/বংশানুক্রমিক রোগ, যেমন: হেমোক্রমাটোসিস, উইলসন্স ডিজিজ।
- অজ্ঞাত কারণসমূহ।
রোগীরা যদি নূন্যতম ছয় মাস বা তার বেশিদিন এই কারণ সমূহে আক্রান্ত থাকে তাহলে লিভারে দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ হয়ে সিরোসিসে রুপান্তরিত হয়। এই রোগের শুরুতে কোন উপসর্গ থাকে না বললেই চলে। তবে আস্তে আস্তে রোগী শারীরিক দুর্বলতা, খুদামন্দা, পেট ফাঁপা, হজমে অনিয়ম এরূপ নানাবিধ সমস্যা নিয়ে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হন। সবচাইতে ভয়াবহ ব্যাপার হল অসুখটি অনেকটা অগ্রসর না হওয়া পর্যন্ত আসক্ত রোগীর কোন শারীরিক সমস্যা বা রোগের কোন লক্ষণ দেখা যায় না।
লিভার সিরোসিস কে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত- Compensated Cirrhosis. এই রোগীরা সিরোসিস অবস্থায় স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় কোন সমস্যা ছাড়া অথবা রক্তবমি বা কালোপায়খানার সমস্যা নিয়ে চিকিত্সকের নিকট আসেন। নিয়মিত শারীরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় এদের অধিকাংশের সিরোসিস ধরা পরে।
দ্ব্বিতীয়ত- Decompensated Cirrhosis. কিছু রোগী শরীরে পানি জমা অবস্থায়, জন্ডিস নিয়ে বা অজ্ঞান অবস্থায় চিকিত্সকের শরণাপন্ন হন। এরাই হল ডিকমপেনসেটেড সিরোসিস এর রোগী।
সিরোসিস আক্তান্ত রোগীর চিকিত্সার জন্য কয়েকটি দিক লক্ষ্যনীয় :-
- রোগ নির্ণয় (Diagnosis)
- রোগের কারণ নির্ণয় (Aetiology)
- রোগের জন্য সৃষ্ট জটিলতা নির্ণয় (Complication)
- রোগীর বর্তমান অবস্থা (Present Status)|
এই চারটি বিষয়ের জন্য রোগীর বেশ কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষা করার প্রয়োজন হয়। মূল চিকিত্সা এই দিকসমূহ বিবেচনায় রেখে করতে হয়। লিভারে দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহের ফলে রোগীরা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থা, শরীরে পানি, বমিভাব ইত্যাদি নিয়ে চিকিত্সকের পরামর্শ গ্রহণ করতে আসেন। তবে অনেকে আসেন এমন অবস্থায় যে ইতমধ্যে তার লিভারের ক্যান্সার হয়ে গেছে। অর্থাত্ রোগীরা সিরোসিস পরবর্তী জটিলতা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। সিরোসিস পরবর্তী এরুপ আরও কিছু জটিলতা হল- গলার রক্তনালী মোটা হওয়া ও রক্তক্ষরণ, বার বার অজ্ঞান হওয়া, পেট ও শরীরে পানি জমা, জন্ডিস, কিডনির বিকলতা, প্রস্রাবে সমস্যা ইত্যাদি।
রোগ প্রতিরোধ এবং অগ্রসর হবার পূর্বে রোগটি নির্ণয়ই হল এ রোগ হতে বাঁচার পূর্বশর্ত। যেহেতু হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস সংক্রমণ বাংলাদেশে এ রোগের প্রধান কারণ, সেহেতু হেপাটাইটিস ‘বি’ এর সংক্রমনণ প্রতিরোধ জরুরী। তাই হেপাটাইটিস ‘বি’ এর টীকা গ্রহণ, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন, ডিসপোজেবল সুঁই ব্যবহার এবং ব্লেড, রেজর, ব্রাশ, ক্ষুর প্রভৃতি যেন বহুজনে ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত মা গর্ভবতী হলে সন্তানের জন্মদানের সাথে সাথে দু’রকম টীকা দেওয়া বাঞ্চনীয়। এছাড়া পরিবারের একজন সিরোসিস আক্তান্ত হলে বাকী সদস্যদের উচিত্ রোগের কারণ অনুযায়ী লিভার ব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।
উন্নত বিশ্বের মত বাংলাদেশেও যতই নগরায়ন ও শিল্পায়ন হচ্ছে ততই বাড়ছে মদ্যপান, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ ও ফাস্ট ফুড কালচারের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত মেদ। যার কারণে লিভারে চর্বি জমার মাধ্যমে সিরোসিস হওয়ার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। তবে নিয়মিত জীবন ও খাদ্যাভ্যাস, নৈতিকতা বিরোধী কাজ পরিহার, পরিশ্রম ও ব্যায়াম এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। আর যারা এ রোগে আক্রান্ত তারা নিয়মিত লিভার ব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও আজীবন চিকিত্সা গ্রহণের মাধ্যমে এর জন্য সৃষ্ট জটিলতা সমূহ হতে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন।
মনে রাখবেন সুশৃঙ্খল জীবন এবং নিয়মিত খাদ্যাভাসই পারে একজনকে সুস্থ রাখতে ও দীর্ঘজীবি করতে। তবে লিভার সিরোসিসে আক্রন্ত হলে কখনই হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সা নিতে ভুল করবেন না। কারণ লিভার সিরোসিসসহ লিভারের যাবতীয় জটিল সমস্যায় হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা বিজ্ঞান অসাধারণ সফলতা দেখিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। প্রয়োজন শুধু অভিজ্ঞ একজন হোমিওপ্যাথের তত্ত্বাবধানে থেকে প্রপার ট্রিটমেন্ট নেয়া। তাই লিভার সংক্রান্ত যেকোনো জটিল পীড়ায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন ও সফল হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা গ্রহন করুন।