হোমিও ইতিহাস

জন্মগ্রহণ ও পারিবারিক পরিচিতিঃ আজ থেকে ২৬২ বৎসর পূর্বে ড্রেসডেন শহর থেকে ১২ মাইল উত্তর পশ্চিমে জার্মানির স্যাক্সনী রাজ্যের এলব (Elbe) নদীর তীরে ক্ষুদ্র শহর মিশেন (Meissen) এর শহরতলির Eck-haus নামের একটি ত্রিতল বাড়িতে ১৭৫৫ সালের ১০ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। বাড়িটির সামনে দিগন্ত বিস্তৃত দ্রাক্ষালতার উর্বর ভূমি। প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে এ বাড়িটির উচ্চতা বেশী হওয়ায় বাড়িটিকে বহুদূর থেকেই দেখা যায়। চিনামাটির পাত্রের চিত্রশিল্পী গটফ্রাইড হ্যানিম্যান এ বাড়িটি ১৭৫৩ সালের ৬ই এপ্রিল কিনেছিলেন। বাড়ির বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে তেমন ভাল নয়। এরই মাঝে উৎকন্ঠা ও আনন্দের মিশ্রণে বাড়ির বাসিন্দাদের মাঝে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে, তার কারণ হচ্ছে বাড়ির গৃহকর্ত্রী গটফ্রাইড হ্যানিম্যানের স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতর। ঘটনার সময় হচ্ছে ১৭৫৫ সালের ১০ই এপ্রিল। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ, বে-ওয়ারিশ কুকুরের ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই, দূরে গির্জার ঘড়িতে রাত বারটার ঢং ঢং শব্দ শোনা গেল, এর কিছুক্ষণ পরেই বাড়ির নিচের তলার একটি ঘরে চারদিকের নিস্তব্দতাকে ভঙ্গ করে নবজাতকের চিৎকার ধ্বনি শোনা গেল, সুন্দর এক দেব শিশু ঘোষণা করে পৃথিবীতে তার আগমন বার্তা, বাড়ির সবার চোখে মুখে ফুটে উঠে আনন্দের ঝিলিক। পিতা মাতা পরিজনেরা শিশুর নধরকান্তি অবয়ব দেখে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানালেন। ধর্মের প্রথানুসারে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুটির নাম পারিবারিক উপাধির সাথে মিলিয়ে রাখা হল ক্রিশ্চিয়ান ফেড্রিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। হ্যানিম্যান হচ্ছে এ পরিবারের পারিবারিক উপাধি। পরবর্তীকালে হ্যানিম্যান নামেই শিশুটি এক অবিনশ্বর কীর্তির মাধ্যমে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর মধ্যে নিজ নাম লেখাতে সমর্থ হয়। শিশুটির পিতা ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রাইড হ্যানিম্যান, পিতামহ ক্রিস্টফ হ্যানিম্যান, মাতা জোহানা ক্রিশ্চিয়ানা। শিশুটি তার মাতার তৃতীয় সন্তান। শিশুটির বড় ভাই অগাষ্ট হ্যানিম্যান, বড় বোন চার্লোটি হ্যানিম্যান, ছোট বোন মিনা হ্যানিম্যান।

শৈশবকাল ও প্রাথমিক শিক্ষা জীবনঃ দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, পিতা মাতা ভাই বোনের স্নেহের ছায়াতলে শিশুটি বড় হতে থাকে। শিশুটি তার সকল ভাইবোনদের চেয়ে একটু আলাদা, বুদ্ধি তার অন্য ভাইবোনদের চেয়ে একটু বেশি, স্বাস্থ্য বরাবরই ভাল, কিন্ত কৌতূহল খুব বেশি, নতুন কোন কিছু দেখলেই প্রশ্ন করে, কেন হয়েছে? কি ভাবে হয়েছে? সমবয়সী অন্যদের চেয়ে তার জানার আগ্রহ অনেক বেশি। শিশুর বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ দেখে মা ভাবেন ছেলেকে তিনি লেখাপড়া শেখাবেন, তা’হলে তার অনেক বড় মাপের মানুষ হবে। আর বাবা ভাবেন এ ছেলেকে তার নিজের কাজ শেখাবেন, তাকে ব্যবসায়ী বানাবেন। পিতা তেমন শিক্ষিত না হলেও জ্ঞানী ছিলেন, তিনি ছেলেকে পাঁচ বছর বয়সে ভাবনার সূত্র বা Thinking lessons পাঠের শিক্ষা দিলেন। ছয় বছর বয়সে পিতা ছেলেকে গ্রামের শিক্ষকদের কাছে লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিয়ে গেলেন। বালক হ্যানিম্যানের বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ গ্রামের শিক্ষককে মুগ্ধ করে, ভাষা শিক্ষা করার ক্ষমতা দেখে শিক্ষকেরা অবাক, তার স্মরণ রাখার ক্ষমতা, নিজে বোঝার ও অন্যকে বোঝানোর ক্ষমতা দেখে শিক্ষকেরা বিস্মিত। কিছুদিন না যেতেই দরিদ্রতার কারণে পিতা চাইলেন লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে, কেননা শিক্ষকদের বেতন দেয়ার সামর্থ্য তখন তার নেই। গ্রাম্য শিক্ষকের মন হাহাকার করে উঠে, বলে কি? এমন সোনার টুকরা ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেনা! শিক্ষকেরা চাইতেন না এ ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হোক, তারা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন এ ছেলে বড় হয়ে মানুষের জন্য মহৎ কিছু করবে, তাই গ্রাম্য শিক্ষকেরা বিনা পারিশ্রমিকেই এই মেধাবী ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে আগ্রহ দেখালেন। এভাবেই চলে বালক হ্যানিম্যানের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন।

স্কুলের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনঃ প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ হলে পিতা তাকে ১৭৬৭ সালের ২০ শে জুলাই ১২ বছর ২ মাস ১০ দিন বয়সে মিশেনের টাউন স্কুলে ভর্তি করে দেন। এ স্কুলে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ভাষাজ্ঞান তার এরূপ যে মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই সহপাঠীদের গ্রিক ভাষার মূল সূত্রগুলো শিক্ষা দিতে পারে, ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞান এরূপ যে পুরাকালের লেখকদের সম্পর্কে সে অনেক কিছুই জানে। তার কথায় সবাই মুগ্ধ। ১৭৭৪ সালে ২০ শে নভেম্বর ১৯ বছর বয়সে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ফার্স্টেন অ্যাডল্যান্ডে স্কুল সেন্ট আফ্রাতে ভর্তি হন। এখানে অধ্যয়নকালে যুবক হ্যানিম্যান ল্যাটিন, গ্রীক, হিব্রু, ইংরেজি, ইতালিয়ান, ফরাসী, স্প্যানিশ, আরবি ও জার্মান ভাষা এবং ইতিহাস, পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় জ্ঞান লাভ করেন। এখানে চিকিৎসাবিদ্যার জনক হিপোক্রেটিসের লেখার সাথে পরিচিত হন এবং তার মনে চিকিৎসাবিদ্যা শেখার আগ্রহ জন্মায়। তিনি তার পিতাকে চিকিৎসাবিদ্যা শেখার আগ্রহের কথা জানালে পিতা প্রথমে এতে সম্মতি দেননি। পিতা তাকে একটি মুদি দোকানে কর্মে নিয়োজিত করেন। এ কাজ হ্যানিম্যানের মোটেই পছন্দ হয়নি, তিনি কাজ ছেড়ে চলে আসেন। পিতার ভয়ে কয়েকদিন মায়ের আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকার পর তার মা পিতাকে বুঝাতে সক্ষম হন যে ছেলেটিকে চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য লাইপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোই উত্তম।

চিকিৎসাবিদ্যা ও অন্যান্য শিক্ষা জীবনঃ চিকিৎসাবিদ্যা শেখার ঐকান্তিক আগ্রহের কারণেই বহু কষ্টের পর তিনি লাইপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার অনুমতি লাভ করেন, মাত্র বিশ ষ্টালিং সম্বল করে ১৭৭৫ সালে তিনি লাইপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন, তখন তার বয়স বিশ বছর। এখানে পড়ার সময় দিনের বেলায় নিজের ক্লাসে যেতেন আর রাতের বেলা ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করতেন, এছাড়াও তিনি ধনী গ্রিক সন্তানদের জার্মান ও ফরাসী ভাষা শেখাতেন। এতে তার অর্থাভাব কিছুটা হলেও দূর হয়েছিল। তার অসামান্য প্রতিভা ও বিভিন্ন বিষয়ে তুলনাহীন প্রজ্ঞা দেখে এখানকার রেক্টর তাকে “প্রতিভা ও প্রজ্ঞার দুই মাথার অসাধারণ মানব’’ আখ্যায়িত করেন। ১৭৭৭ সালে তিনি অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনার লিউপোল্ডষ্টট জেলার ব্রাদার্স অব মার্সি হাসপাতালে চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য ভর্তি হন। ভিয়েনায় তিনি অনুবাদের কাজ থেকে বিরত থাকেন। তিনি সারাক্ষণ নিয়োজিত থাকেন চিকিৎসা শাস্ত্রের অধ্যয়নে। অর্থের টান পড়ায় তখন তার শিক্ষা জীবন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রখ্যাত চিকিৎসক ও হ্যানিম্যানের অকৃত্রিম বন্ধু ভন কোয়ারেন হ্যানিম্যানের আর্থিক দূরবস্থার কথা জানতে পেরে হারম্যানষ্টাডে বাসরত ট্রানসিলভেনিয়ার গভর্নর ব্যারণ এস. ভন ব্রাকেনথালের পারিবারিক চিকিৎসকের কাজ ব্যবস্থা করে দেন। এখানে তিনি একই সাথে গভর্নরের মুদ্রা ও চিত্রকর্মের সংগ্রহশালার তত্ত্বাবধায়ক, লাইব্রেরিয়ান ও পারিবারিক চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৭৭৭ সালের শেষের দিকে হ্যানিম্যান হারমানষ্টাডে গিয়েছিলেন। গভর্নরের লাইব্রেরীর অমূল্য গ্রন্থাবলী তিনি গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করতে থাকেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম হন। এখানকার জীবনের শিক্ষাই তার জীবনের ভিত্তি এনে দেয়। এখানে তিনি প্রাচীন সাহিত্য, জ্যোতিষ শাস্ত্র, বিজ্ঞান ও বিভিন্ন ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ২২ বছর বয়সে যখন তিনি হারম্যানষ্টাড ছেড়ে আসেন তখন তিনি ১১টি ভাষায় সুপণ্ডিত। ১৭৭৯ সালের বসন্তকালে তিনি এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং সেখানে হোফ্রাথ স্কেবারের কাছে উদ্ভিদবিদ্যা আয়ত্ত করেন৷ ১৭৭৯ সালের ১০ই অগাস্ট তিনি এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ ডিগ্রি (এম ডি) লাভ কনে। তার ২০ পৃষ্ঠা ব্যাপী থিসিসের শিরোনাম ছিল Conspectus adectuum spasmodicorum aetiologicus et therapeuticus, যার বাংলা হচ্ছে ’’আক্ষেপিক রোগের কারণ ও চিকিৎসা বিষয়ে অনুসন্ধান’’ ও ইংরেজি হচ্ছে A consideration of the Etiology and Therapeutics of Spasmodic affection।

গ্যালেনিক ধারার চিকিৎসক জীবনঃ ১৭৮০ সাল থেকে তিনি ডিগ্রি ধারী চিকিৎসক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথমে সাক্সনিতে ও পরে হাঙ্গেরির কয়েকটি এলাকায়, জার্মানির ম্যানসফিল্ড রাজ্যের হেটস্টেড শহরে চিকিৎসক হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৭৮১ সালের শেষ দিকে তিনি গোমার্নে (Gommern) জেলা মেডিকেল অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন। এখানেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে সুচিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন ৷

প্রথম বিয়ে ও প্রথম সন্তানের জন্মঃ ১৭৮২ সালে গোমার্নে থাকার সময় জোহনা হেনরিয়েটি লিউপোলডিনি কুসলার কে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন হ্যানিম্যানের দুঃখ, দারিদ্র ও যাযাবর জীবনের সুযোগ্য সহধর্মিণী। ১৭৮৪ সালে হ্যানিম্যানের প্রথম সন্তান হেনরিয়েটির (কন্যা) জন্ম হয়।

অনুবাদক, গ্রন্থ-লেখক, চিকিৎসা পেশা পরিত্যাগ, দরিদ্রতা ও যাযাবর জীবনের শুরুঃ হ্যানিম্যান চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালেই চিকিৎসা গ্রন্থের অনুবাদকের কাজ শুরু করেছিলেন৷ ইতিমধ্যেই হ্যানিম্যানের অনেক অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তিনি ছিলেন তখনকার জার্মানির একজন জনপ্রিয় অনুবাদক৷ হ্যানিম্যান কেবল অনুবাদের খাতিরে অনুবাদ করতেন না, প্রতিটি গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাদা পাদটীকায় নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতেন এবং বিবৃত তথ্যের সংশোধন ও পরিমার্জন করতেন৷ তার এই কাজের জন্য তার অনুবাদকৃত গ্রন্থগুলো বিশেষ মর্যাদা অর্জন করে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক সমাদৃত হয়৷ ১৭৮৪ সালে হ্যানিম্যানের প্রথম মৌলিক গ্রন্থ On the treatment of Scrofulous Sores লাইপজিক থেকে প্রকাশিত হয়৷ তৎকালীন চিকিৎসা জগত ছিল অরাজকতায় পূর্ণ৷ হিপোক্রেটিক, গ্যালেনিক, ম্যাথম্যাটিক্যাল, কেমিক্যাল, হিউমোরাল, ইলেকট্রোগ্যালভানিক মতবাদের ঢেউ নানা রকম বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল৷ সমকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি হ্যানিম্যানকে মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি৷ অকৃত্রিম বন্ধু হিউফল্যান্ডের কাছে এক পত্রে তিনি তার অসন্তোষের কথা জানালেন৷ তিনি লেখেন- প্রচলিত চিকিৎসা বিষয়ক পুস্তক পাঠ করে এবং এ সকল ঔষধ প্রয়োগ করে রোগীদের তেমন উপকার হচ্ছে না, অধিকন্তু এসব ঔষধ ব্যবহারে নতুন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে যা মূল ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক ও বিপদজনক, আর আমি তাদের কোন উপকারই করতে পারছিনা৷ বিবেকের দংশন ও ন্যায়পরায়ণতা তাকে চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রাখা থেকে নিবৃত্ত করে৷ তিনি চিকিৎসা পেশা পরিত্যাগ করেন এবং গোমার্নের মেডিকেল অফিসারের পদ থেকে ১৭৮৪ সালের শরৎকালে পদত্যাগ করেন৷ চিকিৎসা পেশা থেকে বিরত হ্যানিম্যান ফরাসী, ইংরেজি এবং ইতালিয়ান ভাষা থেকে অনুবাদ কর্মে মনোনিবেশ করেন৷ একই সাথে তার প্রিয় বিষয় রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়নে তৎপর হয়ে উঠেন৷ ১৭৮৫ সালে তিনি গোমার্ন থেকে ড্রেসডেনে চলে আসেন৷ শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ ওয়াগনার তাকে শহরের হাসপাতাল সমূহের পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত হবার ব্যবস্থা করেন৷ এটি ছিল দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চ-মর্যাদাপূর্ণ চিকিৎসকের পদ৷ ড্রেসডেনের মনোরম পরিবেশ, পাণ্ডিত্যপূর্ণ আবহ ও সাংস্কৃতিক চেতনায় সুশোভিত কর্মোপযোগী পরিবেশে হ্যানিম্যান বেশ আনন্দের সাথে চার বছর অতিবাহিত করেন৷ ড্রেসডেন যেন হ্যানিম্যানের জীবনের স্রোত প্রবাহে গতিশীলতা এনে দেয়৷ ১৭৮৬ সালে হ্যানিম্যানের ২য় সন্তান ফ্রেডরিকের (১ম পুত্র) জন্ম হয় এই ড্রেসডেনেই৷ ১৭৮৬ সালে তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ Poisoning by Arsenics, Its Treatment and Judicial Investigation প্রকাশিত হয়৷ ১৭৮৭ সালে হ্যানিম্যানের পিতার মৃত্যু হয়৷ ১৭৮৯ সালে তিনি স্যার যোশেফ ব্যারিংটন লিখিত ইংরেজি গ্রন্থ History of the lives of Abelard and Heloise জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন৷ একই বৎসর আরেকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ Exact mode of preparing the soluble Mercury প্রকাশিত হয়, যা হ্যানিম্যানের কট্টর নিন্দুকদেরও সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৷ ১৭৮৯ সালে তিনি লাইপজিক ফিরে আসেন৷
হাসপাতালসমূহের পরিদর্শকের পদে থাকাকালে তিনি ঔষধ প্রস্ততকারকদের প্রতারণামূলক কৌশলের ও অসাধুতার পরিচয় পেয়েছিলেন৷ তিনি তাদেরকে সৎ হতে বলেন এবং যথাযথ নিয়ম মেনে ঔষধ প্রস্তুত করতে বলেন৷ এতে করে তিনি ঔষধ প্রস্ততকারকদের কোপানলে পড়েন এবং সরকারী কোন পদে না থাকার ফলে সহজেই তাদের নির্যাতনের শিকার হন৷ তিনি চিকিৎসা পেশা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ জীবিকা নির্বাহের জন্য একমাত্র অবলম্বন অনুবাদ কর্ম, অনুবাদ কর্ম ভরণপোষণের জন্য মোটেই যথেষ্ট ছিল না, তিনি অন্তহীন দরিদ্রতার শিকার হয়েছিলেন৷ তিনি প্রায় আর্তনাদের ভাষায় বলেছেন Where shall I look for aid, sure aid?

হ্যানিম্যানের গবেষণা, হোমিওপ্যাথির মূলসূত্র আবিষ্কার, কর্মব্যস্ত ও নির্যাতিত জীবনঃ ১৭৯০ সালে উইলিয়াম কালেনের ইংরেজিতে লেখা “এ ট্রিয়েটিস অব মেটেরিয়া মেডিকা” অনুবাদ-কালে পেরুভিয়ান বার্ক এর চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্যে দ্বিমত পোষণ করেন৷ ডাঃ কালেনের গ্রন্থে প্রাচীন একটি মতবাদ উল্লেখ ছিল যে, পেরুভিয়ান বার্ক পাকস্থলীর উপর বলকারক ক্রিয়া প্রকাশ (Tonic effects on stomach) করে জ্বর ভাল করে থাকে৷ তার মনে নানা রকম প্রশ্নের উদয় হয়, এটি কি একই ধরনের উপসর্গের জন্ম দেয় যা আবার বিদূরিত করে? তা কি সদৃশ অবস্থা সৃষ্টি করে কম্পজ্বর নিবারণ করে? অনুসন্ধানী হ্যানিম্যান পেরুভিয়ান বার্ক এর রস সেবনের মাধ্যমে নিজ দেহে পরীক্ষা করেন৷ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন যে, সবিরাম জ্বরের ঔষধ হিসাবে পেরুভিয়ান বার্ক কাজ করে, কেননা সুস্থ মানুষের শরীরে তা সবিরাম জ্বরের সদৃশ লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে৷ হ্যানিম্যান তার তত্ত্ব প্রমাণে ছয় বছর ধরে গবেষণা চালান এবং অবশেষে তিনি তার আবিষ্কার ও সিদ্ধান্তের কথা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন৷ তিনি প্রমাণ সহকারে ঘোষণা দেন যে, কোন ঔষধকে সুস্থ মানুষের শরীরে পরীক্ষা বা প্রুভিং করে যে সকল লক্ষণ পাওয়া যাবে অনুরূপ লক্ষণের প্রাকৃতিক রোগগ্রস্থ রোগীকে সেই ঔষধ আরোগ্য করতে পারে৷ তার আবিষ্কৃত এই আরোগ্য নীতিকে তিনি ল্যাটিন ভাষায় সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার বা সদৃশ নীতিতে আরোগ্য সাধন বলে অভিহিত করেন৷ ইতিপূর্বে হিপোক্রাটিস, গ্যালেন, চরক, ইবনে সিনা, প্যারাসেলসাসও তাদের লেখায় সদৃশ নীতির কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু আরোগ্যের একমাত্র নিয়ম হিসাবে কেউই দাবী করেননি৷ হ্যানিম্যান তার আবিস্কৃত এই নীতিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও হাতে কলমে প্রমাণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন৷ যেহেতু হানিম্যানের আবিষ্কারের পূর্বেও সদৃশ নীতি প্রকৃতিতে ছিল ও অনেকে তা প্রয়োগ করে চিকিৎসা করেছেন সে জন্য হ্যানিম্যানকে সদৃশ আরোগ্য পদ্ধতির পুনঃ আবিষ্কারক (Discoverer) বলা হয়, নতুন আবিষ্কারক বা উদ্ভাবক (Inventor) বলা হয় না এবং হ্যানিম্যান এই দাবীও কখনো করেননি৷ হ্যানিম্যান বিনয়ের সাথে বলতেন যে তার আবিষ্কার হচ্ছে মানবতার কল্যাণের জন্য তাকে প্রদত্ত ঈশ্বরের আশীর্বাদ৷ ১৭৯৯ সালে তিনি মেইশেনের বিজ্ঞান একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন৷ ইতিমধ্যে ১৭৯২ সালে তিনি টুরিগেন জংগলে জর্জেন্থেল পাগলা গারদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ এখানে তিনি তার নব আবিস্কৃত চিকিৎসানীতি পরীক্ষা করার এক অপূর্ব সুযোগ লাভ করেন৷ জর্জেন্থেল পাগলা গারদের পরিচালক বিচারক জেকব কিছুদিন পর জানতে চান তার চিকিৎসাকেন্দ্রে আর কতজন পাগল বা মাতাল আছে? হ্যানিম্যান মুখ বিকৃত করে জবাব দেন যে একজন মাত্র পাগল রয়ে গেছে এবং সেটি তিনি নিজেই। মাতাল বা পাগলদের সাথে তার সৌজন্যমূলক আচরণ ও নতুন নীতিতে প্রয়োগকৃত ঔষধ দ্রুত তাদের আরোগ্য প্রদান করেছিল। সে সময় মানসিক রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল ভয়াবহ, নিষ্ঠুর দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে বশীভূত রাখার চেষ্টা করা হতো৷ তিনি বলেন এরা সর্বাপেক্ষা অসহায়, দৈহিক নির্যাতন নয় মায়া মমতা, স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে এদেরকে চিকিৎসা করতে হবে৷ মানসিক রোগের চিকিৎসায় হ্যানিম্যান প্রবর্তিত ধারা সূচনা করে উন্মাদ রোগের চিকিৎসায় উন্নততর ব্যবস্থা।
১৭৯৬ সালে কনিংসলুটারে অবস্থানের সময় হ্যানিম্যান হিউফল্যান্ডের জার্নালে লিখলেন তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের উপর একটি প্রবন্ধ, Essay on a new principle for ascertaining the curative powers of drugs, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ঔষধের আরোগ্য-কারী শক্তি নির্ধারণে নতুন নিয়মনীতি সম্পর্কে পরীক্ষা নিরীক্ষা৷ তার এ লেখার ফলে বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালে এ লেখার তীব্র সমালোচনা হতে থাকে। তৎকালীন চিকিৎসক সম্প্রদায় ও ঔষধ-বিক্রেতারা প্রায় সবাই তার শত্রু হয়ে যায়। হিংসুটে ডাক্তারদের ঈর্ষা ও নির্যাতনের ফলে তাকে অকৃতজ্ঞ শহর কনিংসলুটার ত্যাগ করতে হয় এবং তিনি যাযাবরের মত এক শহর থেকে অন্য শহরে আশ্রয়ের অন্বেষণ করতে থাকেন৷ তার ঔষধ-পত্র জ্বালিয়ে দেয়া হয়, যাত্রাপথে ভয়ানক দুর্ঘটনায় তার শিশুপুত্র নিহত হয়, এক মেয়ের পা ভেঙ্গে যায়। আশ্রয়ের সন্ধানে বিভিন্ন শহর ঘুরে ঘুরে ১৮০৫ সালে তিনি টুরগেও শহরে আসেন এবং ১৮১১ সাল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এখানে আসার পর ১৮০৬ সালে ল্যাটিন ভাষায় লিখিত আলবার্ট ফন হ্যালার এর মেটেরিয়া মেডিকা অনুবাদ করেন এবং এটি হচ্ছে তার সর্বশেষ অনুবাদ গ্রন্থ। একই বছরে বার্লিন থেকে প্রকাশিত হয় Medicine of Experience গ্রন্থটি। বিশেষজ্ঞদের মতে এটি হচ্ছে ১৮১০ সালে প্রকাশিত Organon of Rational Healing গ্রন্থের অগ্রবর্তী ভাষ্য। ১৮০৫ সালে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয় তার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ Fragmenta de veribus medicamentorum positivis sive in sano corpore observatis। এই গ্রন্থটির প্রথমাংশে ঔষধের লক্ষণাবলী ও দ্বিতীয় অংশে লক্ষণের সূচীপত্র দেয়া ছিল। এ গ্রন্থে তিনি সুস্থ মানুষের শরীরে ভেষজের ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট উপসর্গ এবং ভুলক্রমে বা দুর্ঘটনার ফলে বা দৈবক্রমে ঘটে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট উপসর্গের বর্ণনা ইতিপূর্বে বিভিন্ন চিকিৎসক লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা সূত্র উল্লেখ করে বর্ণনা করেন এবং নিজের পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল উল্লেখ করেন। ১৮১০ সালে প্রকাশিত হয় হোমিওপ্যাথির বাইবেল নামে কথিত Organon of Rational Healing গ্রন্থটি, যা পরবর্তীতে অর্গানন অব মেডিসিন নামে হোমিওপ্যাথি জগতে পরিচিত হয়েছে। এই অর্গানন গ্রন্থেই তিনি সর্বপ্রথম হোমিওপ্যাথি শব্দটি উল্লেখ করেন। শব্দটির সূত্র হল দুটি গ্রিক শব্দ যথা- Omois (Similar) এবং Pathos (Disease) শব্দ দুটির সমন্বয়ে Homoeopathy শব্দের উদ্ভব। একই সাথে তিনি প্রচলিত পুরাতন পদ্ধতির চিকিৎসা ব্যবস্থাকে Allopathy নামে অভিহিত করেন। গ্যালেন প্রবর্তিত বিসদৃশ চিকিৎসাবিধান হ্যানিম্যানের দেয়া নাম নিয়েই আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত, তারপরেও অ্যালোপ্যাথরা হ্যানিম্যানকে শ্রদ্ধা জানাতে কুন্ঠিত। হায় রে, অকৃতজ্ঞ চিকিৎসক সমাজ।
হ্যানিম্যানের জীবদ্দশায় অর্গানন গ্রন্থটির পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং মৃত্যুর পূর্বে ৬ষ্ঠ সংস্করণের পাণ্ডুলিপি তৈরি শেষ করেন। বিশ্বের বহু ভাষায় এ গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ গ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি বিশেষ করে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার অকার্যকারিতাকে প্রমাণ করে হোমিওপ্যাথিকেই একমাত্র আদর্শ ও নীতি বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা বিধান বলে দাবি করেন। অর্গানন প্রকাশিত হলে চিকিৎসা জগতে এক ভয়াবহ সংঘাতের সূচনা করে। বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে প্রবল বিরোধিতার ঝড় উঠে। যে ভাবেই হোক হ্যানিম্যানের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে হবে। অসহ্য এই নতুন সক্রেটিসের আস্ফালন, তারা হ্যানিম্যানকে হাতুড়ে বৈদ্য, অজ্ঞ, মূঢ়, শয়তানের অবতার, নির্বোধ, অলস মুচীদের গুরু ইত্যাদি নানা রকম গালিগালাজ-পূর্ণ উপাধি দিতে থাকে। তার সূক্ষ্ণমাত্রাকে অবাস্তব ঘোষণা দেয়া হয়, তার ভেষজ গবেষণাকে হাস্যকর আখ্যায়িত করা হয়৷ ১৮১১ সালে হ্যানিম্যান অযথা বিতর্কে না জড়িয়ে বিশ্ববাসীকে মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা উপহার দেন। তিনি বলেন- বাকপটুতা রোগের নিরাময় করে না, করে এর বিধান। লাইপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাশাস্ত্র বিভাগের নির্ধারিত ফি প্রদান করে সেখানে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগে তার মতামতকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। ১৮১১ থেকে ১৮২১ সাল পর্যন্ত তিনি লাইপজিকে অবস্থান করেন, এ সময়কে হ্যানিম্যানের জীবনের সংগ্রাম-কাল ও সংঘাতময় জীবন বলে অভিহিত করা হয়। কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ও আদালতের রায়ের কারণে তিনি লাইপজিকে অবস্থানকে বিরক্তিকর মনে করেন। হ্যানিম্যানের তখন বয়স ৬৬ বৎসর, ৪২ বৎসর কাল তিনি চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত। ১১টি ভাষায় সুপণ্ডিত, নামকরা অনুবাদক, রসায়নবিদ, ঔষধ প্রস্তুতবিদ, উদ্ভিদবিদ, পদার্থবিদ, বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বিগত ২৫০০ বছরের চিকিৎসার ইতিহাস ও ধারা যার নখদর্পণে, প্রকাশিত গবেষণা মূলক গ্রন্থ, অনুবাদ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ১২০, শিক্ষাবিদ, তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারায় এম. ডি ডিগ্রি ধারী, মানসিক ব্যাধির সফল চিকিৎসক ইত্যাদি বহুবিধ গুণের অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হ্যানিম্যানকে লাইপজিক তার যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি।  তার প্রবর্তিত অসাধারণ আরোগ্য-বিধান বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে তার কাছে চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য ছাত্ররা পঙ্গপালের মত ছুটে আসতে থাকে, চিকিৎসা নেয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে আসতে থাকে রোগাক্রান্ত মানুষের ঢল। তারপরেও চলে এই মহান মানুষটির উপর চিকিত্সক নামধারীদের মানসিক নির্যাতন। এমতাবস্থায় হ্যানিম্যানের শিষ্যরা রাজার কাছে আবেদন জানান যে, হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে ঔষধপ্রস্তুতকারক ও হিংসুটে চিকিৎসকদের নির্যাতন বন্ধ করার জন্য যেন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। হ্যানিম্যান ও তার শিষ্যদের অপেক্ষা কবে আসবে রাজার নির্দেশ, অবসান হবে দুর্ভোগের ?

শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনঃ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পূর্বেই এমন পরিস্থিতিতে অবশেষে মহান স্রষ্টার আশীর্বাদে হ্যানিম্যানের জীবনে পরিপূর্ণতা, শান্তি ও মর্যাদার পরশ দিতে কোথেনের ডিউকের কাছ থেকে একটি প্রশংসিত চিঠি পান। ১৮২১ সালের জুন মাসে কোথেন এর ডিউকের কাছ থেকে হ্যানিম্যান আমন্ত্রণ-লিপি পেলেন- হ্যানিম্যান সম্মত হলে তিনি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে হ্যানিম্যানকে নিযুক্ত করে সম্মানিত হতে চান এবং তিনি যদি তার পেশা চালিয়ে যেতে চান তা’হলে ডিউক তাকে সার্বিক সহযোগিতা করবেন। হ্যানিম্যান এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করে কোথেনে চলে আসেন এবং ১৮২১ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত কোথেনে ছিলেন। কোথেনে তিনি সুন্দর ও সংঘাত-হীন জীবনযাপন করেছেন। ১৮২১ সালে ৩০শে নভেম্বর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার অনুমতি প্রদান করে রাজকীয় নির্দেশ জারী করা হয়, যা হচ্ছে হোমিওপ্যাথির প্রথম সরকারী স্বীকৃতি। কোথেনের ডিউক ফার্ডিনান্ড এবং তার স্ত্রী জুলি ছিলেন হ্যানিম্যানের একনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী।  হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হয়ে এক পত্রে তিনি লেখেন- নিপীড়িত মানবতার সেবায় আরও যাতে বহু বছর আপনি নিয়োজিত থাকতে পারেন তার জন্য ঈশ্বরের কাছে আপনার সুস্বাস্থ্য সংরক্ষণের প্রার্থনা জানাচ্ছি।

হোমিওপ্যাথির গতিরোধে আদালতের রায়ঃ বিভিন্ন দেশে হ্যানিম্যান ও তার অনুসারীদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হয় ছয় বার- ১৮২৮ সালে ভিয়েনায়, ১৮২৭ সালে রাশিয়ায়, ১৮২৯-৩০ সালে সেন্ট পিটাসবার্গে, ১৮৩০-৩১ সালে মিউনিখে, ১৮৩৪ সালে প্যারিসে, ১৮৩৫ সালে নেপলস এ, আর এসব হচ্ছে এলোপ্যাথিক চিকিৎসকদের কীর্তি।  রায়ে কোথায়ও অর্থদণ্ড, কোথায়ও-বা হোমিওপ্যাথিকে নিষিদ্ধ করা হয়।

হ্যানিম্যানের পরিণত বয়সের আবিষ্কারঃ কোথেনের শান্তিময় জীবনকালে তিনি দুশ্চিন্তাহীন জীবন যাপন করেছেন এবং শান্তভাবে গবেষণা ও চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছেন। মানব কল্যাণে আরও ভাল কিছু করা যায় কিনা এ চিন্তায় তিনি রাত দিন পরিশ্রম করেছেন। তিনি তার পরিণত বয়সে সারা জীবনের লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে ১৮২৮ সালে লিখেন The Chronic Disease, There Peculair Nature and Homoeopathic Cure।  গ্রন্থটি জার্মান ভাষায় লিখিত হয় এবং পরবর্তীতে এর সংস্করণ ও পরিবর্ধন করা হয়। এ গ্রন্থে হ্যানিম্যান ক্রনিক রোগের জন্য সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিস মায়াজম রোগ-বিষকে দায়ী করে এদের বিস্তারিত বর্ণনা এবং এন্টি মায়াজমেটিক চিকিৎসা প্রণালী ব্যাখ্যা করেন। ক্রণিক রোগের চিকিৎসা ধারার এ ধরনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনা বিশ্বে এই প্রথম।

প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুঃ ১৮৩০ সালের ৩১শে মার্চ হ্যানিম্যানের জীবনের সবচেয়ে বেদনা বিধুর দিন। এ দিন তার প্রিয়তমা স্ত্রী জোহনা হেনরিয়েটি লিউপোলডিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯ বছর বয়সে ২৮ বছরের হ্যানিম্যানের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল, মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। ৪৮ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন হ্যানিম্যানের ভয়ঙ্কর ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দিনে বিশ্বস্ত সাথী ও দরদী বন্ধু  লেখাপড়া ও গবেষণায় যাতে হ্যানিম্যান অধিকতর মনোযোগী হতে পারেন তার জন্য পরিবারের সার্বিক দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই বয়ে বেড়াতেন   স্বামীর জন্য তিনি সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছেন। স্বামীর সৃষ্টিশীল মনের মন্দিরে তিনি নিজকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।  হ্যানিম্যান তাকে আদর করে ফ্রাউ বলে ডাকতেন।  তিনি দু ছেলে ও নয় মেয়ের মা হয়েছিলেন। শোকাভিভূত হ্যানিম্যান আজীবনের বন্ধু ও সহকর্মী ষ্টাফকে বেদনা-বিধুর পত্রে এ শোক সংবাদ জানালেন।  তিনি লিখেন- বহু বছর ধরে আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন৷ তিন বছর ধরে তিনি লিভার এবসেস রোগে প্রায় মৃত অবস্থায় ছিলেন। ফোড়াটি ফেটে যাবার কারণে বহু কষ্ট পেয়ে- জ্বর ও যন্ত্রণায় ৩১মে মার্চের মধ্যরাত্রের কিছু পরে তিনি মারা যান।  আপনি আমাকে দেখতে আসবেন, দেখতে পাবেন আমি ঠিক আগের মতই ঈশ্বরের প্রদত্ত দর্শনশাস্ত্রে জড়িয়ে রয়েছি।

কোথেনের ডিউক মৃত্যুঃ ১৮৩১ সালে আসে আরেকটি মানসিক আঘাত৷ হ্যানিম্যানের সংকট দিনের অকৃত্রিম বন্ধু, যার সহানুভূতি, সমর্থন, প্রীতি ও মমত্ববোধ বিপক্ষের বিরোধিতা ও সমালোচনা থেকে উদ্যম জুগিয়েছে সেই ডিউক ফার্ডিনান্ড ১৮৩১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তী ডিউক হেনরী হ্যানিম্যানকে তার ভাই ফার্ডিনান্ডের মত জোরালো সমর্থন দেন নি, তিনি এলোপ্যাথিক চিকিৎসকদের প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করেন। তারপরও কোথেনে ১৮২৯ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত হ্যানিম্যান বেশ আনন্দে ও সুখেই ছিলেন।

বিশ্বব্যাপী হ্যানিম্যানের চিকিৎসা ধারার প্রচার ও বিকাশঃ ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হোমিওপ্যাথি প্রতি আস্থাবান ব্যক্তিরা হোমিওপ্যাথির তীর্থভূমি কোথেন পরিদর্শনে আসতেন, হানিম্যানের কাছে হোমিওপ্যাথির দীক্ষা নিতে আসতেন। আমেরিকা ও নিউইয়র্কে সীমিত পর্যায়ে হলেও হোমিওপ্যাথির চর্চা শুরু হয়, রাশিয়া, ফিলাডেলফিয়া, ভারতবর্ষে ও ইংল্যান্ডে হোমিওপ্যাথির প্রসার ঘটে। বিভিন্ন দেশে হোমিওপ্যাথিক সোসাইটি গড়ে উঠে৷ আয়ারল্যান্ডে চালর্স এইচ ডেভরিয়েন্ট জার্মান ভাষার অর্গানন ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। ১৮৩০ সালে অর্গানন হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় অনুদিত হয় । সে সময় হ্যানিম্যান প্রচুর রোগী দেখেছেন এবং রোগীর যে ইতিবৃত্ত তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা এক সুবিশাল মেডিকেল বিশ্বকোষ। ১৮৩৩ সালের ২২শে জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় Clinicum Homoeopathicum নামে লাইপজিক হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল ও মেডিকেল স্কুল, যা লাইপজিক জার্মান হোমিওপ্যাথিক সেন্ট্রাল ইউনিয়নের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল, এতে হ্যানিম্যানের শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন ছিল। ১৮৩৪ সালে হ্যানিম্যান লাইপজিক হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন, এখানে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দেয়া হয়।  তিনি সংবর্ধনার জবাবে বলেন – Vox populi, vox dei অর্থাৎ মানুষের কণ্ঠেই মহান সৃষ্টিকর্তার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়।

হ্যানিম্যানের দ্বিতীয় বিয়ে, প্যারিসে গমন ও হোমিওপ্যাথির বিশ্বজয়ঃ কোথেনে অবস্থান কালে ১৮৩৫ সালের ২৮শে জানুয়ারি ৮০ বছর বয়সে হ্যানিম্যান ৩২ বছর বয়সী ফরাসী মহিলা মাদাম মেরী মেলানী ডি. হ্যারভেলীকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন ফরাসি প্রজাতন্ত্রের বিচার মন্ত্রী লুই জেরোমি গহিয়ার পালিতা কন্যা। ইউরোপের সবচেয়ে খ্যাতিমান চিকিৎসকরা মেলানির চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে ছিলেন, তিনি হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় স্বল্প সময়ে আরোগ্য লাভ করেন এবং হ্যানিম্যানের সৌরভে বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন হ্যানিম্যান একজন বিরল প্রতিভাসম্পন্ন পুরুষ৷ মাদাম মেলানী ছিলেন একজন বড়ো মাপের চিত্র শিল্পী, তিনি কবিতা লিখতেন এবং সুন্দর করে পিয়ানো বাজাতে পারতেন। বিয়ের পর মাদাম হ্যানিম্যান প্যারিসে ফিরে যেতে যান, তারই ইচ্ছার মূল্য দেয়ার জন্য ১৪ বৎসর কোথেনে বসবাসের পর হ্যানিম্যান ১৩ ই জুলাই ১৮৩৫ সালে নববধূ সহ প্যারিসে চলে আসেন। প্যারিসে আসার পূর্বে ১৮৩৫ সালের ২রা জুন হ্যানিম্যান তার সকল সহায় সম্পদ তার ওয়ারিশদের মধ্যে উইলের মাধ্যমে দান করে কপর্দকহীন অবস্থায় প্যারিসে আগমন করেন, বিয়ের আংটি ছাড়া মাদাম মেলানী আর কিছুই তখন গ্রহণ করেন নি।  সে বছরের ১০ই এপ্রিল, তার জন্মদিনে হ্যানিম্যান আমেরিকান হোমিওপ্যাথির সদস্য নির্বাচিত হন। কিছু দিন পরে তার স্ত্রী উক্ত একাডেমী থেকে অনারারী ডিপ্লোমা লাভ করেন।  ১৮৩৫ সালের ১২ই অক্টোবর হ্যানিম্যান প্যারিসে চিকিৎসা করার জন্য রাজকীয় অনুমতি লাভ করেন। হ্যানিম্যান মাদাম মেলানীর সান্নিধ্যে স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করেছেন, প্যারিসে তিনি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক আতিথেয়তা পেয়েছেন। তার চেম্বারে রোগীদের আগমনে জনাকীর্ণ থাকতো, দূর দূরান্ত থেকে রোগীরা তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসত।  এখানে আসার পর তিনি আর নতুন কোন গ্রন্থ লিখেননি, তবে ক্রনিক ডিজিজ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ সংশোধন করেছেন এবং অর্গানন গ্রন্থের ৬ষ্ঠ সংস্করণের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন, যা তার মৃত্যুর ৭৮ বৎসর পরে ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়। ১০ই অগাস্ট ১৮৮৯ সালে হ্যানিম্যানের ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্তির ৬০ বছর পূর্ত্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি প্রতিনিধি প্রেরণ করে, কিন্তু জার্মানি রহস্যজনক-ভাবে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, জার্মানি এ বিরল প্রতিভার যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি। প্যারিসে আসার পর হ্যানিম্যানের খ্যাতি অন্তত দশ গুণ বেড়ে যায়। আমেরিকার কনষ্টাইন হেরিংকে তিনি তার সবচেয়ে দক্ষ শিষ্যদের অন্যতম মনে করতেন। ডাঃ হেরিং প্রুভিংকৃত ল্যাকেসিস, ক্রোটেলাস আমেরিকা থেকে তার কাছে প্রেরণের জন্য পত্র লিখেছিলেন। তার শিষ্যদের মধ্যে ডাঃ লেহম্যানকে তিনি তার লাইপজিকের চেম্বারে বসিয়ে এসেছিলেন।  ডাঃ জার ও ডাঃ বোনিংহাউসেনের হোমিওপ্যাথিতে অবদানের কথা অর্গাননের ১০৮ নং পাদটীকায় উল্লেখ করেছেন।

শেষজীবন, মৃত্যু ও সমাধীঃ নদীর জোয়ারের পর দেখা দেয় ভাটার টান। প্যারিসে আসার পর অনাবিল সুখ, শান্তি, সম্মান, প্রাচুর্য পেলেও যেটি পাননি সেটি হচ্ছে বিশ্রাম। তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে৷ ১৮৪৩ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিগত এক দশক ধরে প্রত্যেক বসন্তকালেই শ্বাসনালীর শ্লেষ্মা-ঘটিত প্রদাহ বা Bronchial catarrh এ আক্রান্ত হতেন, মৃত্যুর পূর্বের শেষ ১৩ ঘণ্টা ক্রমান্বয়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়ে শ্বাসরোধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে।  সময়টি হচ্ছে ১৮৪৩ সালের ২রা জুলাই রোববার ভোর ৫টা এবং স্থানটি হচ্ছে প্যারিসের উত্তরে রুই দ্যা মিলান নামক স্থানে নিজ বাসবভনে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বৎসরের কিছু বেশি। অসুস্থাবস্থায় প্রথম দিকে তিনি নিজেই নিজের চিকিৎসা করতেন। শেষ দিকে হ্যানিম্যানের অনুমতিক্রমে ও তার নির্দেশে মাদাম মেলানী ও ডাঃ চেট্রন তার চিকিৎসা করতেন। হ্যানিম্যান মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তার সমাধি লিপি উচ্চারণ করেন, সমাধি লিপির শব্দগুলো হচ্ছে Non inutilis vixi (I have not lived in vain)- অর্থাৎ আমি বৃথা জীবনধারণ করিনি৷ হ্যানিম্যানের শেষকৃত্য পালনের জন্য তার বন্ধু বান্ধব ও গুণগ্রাহীরা উপস্থিত হয়েছিলেন কিন্তু মাদাম মেলানী সবাইকে নিদারুনভাবে হতাশ করে কোনরূপ আনুষ্ঠানিকতা না করে মন্টমার্ট্রে সমাধিস্থলে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম এর মতো হ্যানিম্যানকে সমাহিত করেন। যদিও প্যারিসে অবস্থানের আট বছরের মধ্যে ৪০ লক্ষ ফ্রাংক মূল্যের সম্পত্তি হ্যানিম্যান জমিয়ে ছিলেন এবং যার সবই ছিল মাদাম মেলানীর অধিকারে। সমাহিত করার সময় মাদাম মেলানীর সাথে ছিলেন হ্যানিম্যানের এক কন্যা, লেথিয়ার নামে একজন তরুণ চিকিত্সক, মাদাম লাইবি ও তার ছেলে।  হ্যানিম্যানের প্রতি মেলানীর ভালবাসায় কোন খাদ ছিলনা একথা সবাই স্বীকার করেন, যাকে হ্যানিম্যান অন্ধের মত ভালবাসতেন, যার জন্য তিনি নিজ দেশ ও সন্তানদের ছেড়ে প্যারিসে চলে এসেছিলেন, তিনি কেন এরূপ আচরণ করেন সে এক রহস্যময় ইতিহাস। শোনা যায় ঈশ্বরবাদী হ্যানিম্যান শেষ জীবনে ধর্মান্তরিত হয়ে খিষ্ট্র ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ছিলেন । মাদাম ম্যালানি চেয়েছিলেন হ্যানিম্যান মুসলমানের দ্বারা সমাহিত হোক এবং এই ইচ্ছা থেকেই মৃত্যুর ৯ দিন পর ১১ই জুলাই হ্যানিম্যানকে কবরস্থ করেন।  এর সত্য মিথ্যা আল্লাহই জানেন। পরবর্তীতে ১৮৯৪ সালে ফ্রান্সের Cimetiere du Pere-Lachaise সমাধি ক্ষেত্রে তাকে পুনরায় সমাহিত করা হয়।

হ্যানিম্যান লিখিত (ফ্র্যাগম্যান্টা ডি ভেরিবাস, মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা, ক্রনিক ডিজিজ) গ্রন্থত্রয়ে নিজদেহে মোট ১০৯টি ঔষধের প্রুভিং এর বিবরণ পাওয়া যায়, এছাড়াও তাঁর শিষ্যদের রচিত গ্রন্থাবলীতে আরও কয়েকটি ঔষধের প্রুভার হিসাবে হ্যানিম্যানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সে ভাবে হিসেব করে দেখা যায় যে, হ্যানিম্যান প্রুভিংকৃত ঔষধ সংখ্যা মোট ১৩০টি। বর্তমানে হোমিওপ্যাথিতে ব্যবহৃত ঔষধ সংখ্যা প্রায় চার হাজার। আজ বিশ্বের বহু-দেশে হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি মর্যাদার আসনে অবস্থান করছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়া, জার্মান, গ্রীস সহ বহু-দেশ হোমিওপ্যাথিকে সরকারী স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ হোমিওপ্যাথিকে অল্টারনেটিভ মেডিসিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে একমাত্র অর্গানন ভিত্তিক চিকিৎসা ধারাকেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হ্যানিম্যানের জন্মদিন বেশ ঘটা করেই পালন করে হ্যানিম্যানকে সম্মান জানায়। আমেরিকার ওয়াশিংটন ও ফ্রান্সের প্যারিস সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হ্যানিম্যানের ৯টি ভাস্কর্য ও স্মৃতিসৌধ হ্যানিম্যানের অমর স্মৃতির ও সম্মানের স্বাক্ষর বহন করছে। হ্যানিম্যান তোমায় লাল সালাম।
সিন্ধুর মত বিশাল কর্মময় জীবনের বিন্দু পরিমাণ বিষয় এতক্ষণ আলোচিত হল, হ্যানিম্যানের জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে আলোচনা করা গেলনা। সবশেষে বলতে হয়- যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন রোগ, রোগী, চিকিৎসা থাকবে, ততদিন চিকিৎসা শাস্ত্রের এই মহান পুরুষের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে৷