শ্বাসকষ্ট (অ্যাজমা বা হাঁপানি) ও তার প্রতিকার

বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জেন যেমন-ধুলা-বালি, ধোঁয়া, ফুলের রেণু, কলকারখানার নির্গত বিষাক্ত গ্যাস, গাড়ির ধোঁয়া, বিশেষ কিছু খাবার, ওষুধ ইত্যাদি অ্যালার্জি ও অ্যাজমার সৃষ্টি করে। যে কোনো সুস্থ ব্যক্তির অ্যালার্জি হতে পারে। সামান্য উপসর্গ হতে শুরু করে মারাত্মক উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি হঠাৎ তীব্র আকারে আক্রমণ করতে পারে। নিউইয়র্কে গবেষকরা বলেছেন যে, যানবাহন রাজপথে হাঁচি উদ্রেককারী অ্যালার্জেন সৃষ্টি করে।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মতে, প্রস্তর ফলক, ইস্টক প্রভৃতি দ্বারা আস্তর করার পথে বিভিন্ন উৎস হতে কমপক্ষে ২০টি অ্যালার্জেন পাওয়া যায়। ফুটপাতের ধূলিকণাকে বর্ণনা করেন এভাবে যে এগুলো হচ্ছে মৃত্তিকার ধুলা গাড়ির গচ্ছিত নিঃশোষিত পদার্থ, টায়ারের ধুলা, গাছ পাতার খণ্ড এবং অন্যান্য যৌগিক পদার্থের জটিল সংমিশ্রণ। পথের ধুলা শহরবাসীদের অ্যালার্জি/অ্যাজমাতে প্রবলভাবে গ্রহণ করে। কারণ রাজপথ দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন, লোকজন প্রভৃতির মাধ্যমে এগুলো দ্রুতবেগে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়। তাদের মতে শতকরা ১২ ভাগ শহরবাসী নিঃশ্বাসের সঙ্গে এমন বায়ুবাহিত অ্যালার্জেন সৃষ্টি করে।

গবেষকদের মতে, রাজপথের খুব নিকটতম বসবাসকারীদের পথের ধুলার সাথে সম্পর্কযুক্ত অ্যালার্জি ও অ্যাজমার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি এবং রাস্তার ১০০ মিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে কাশি, হুইজ, রানিংনোজ এবং নির্ণীত অ্যাজমার প্রকোপ অধিক। অ্যাজমা এবং অ্যালার্জি নিঃসন্দেহে একটি যন্ত্রণাদায়ক স্বাস্থ্য সমস্যা, তাই অ্যালার্জি ও অ্যাজমা যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা উচিত। অ্যালার্জির সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। কী কারণে এবং কোন কোন খাবারে আপনার অ্যালার্জি দেখা দেয় তা শনাক্ত করে পরিহার করে অ্যালার্জি হতে রেহাই পাওয়া সম্ভব।

অ্যালার্জি সৃষ্টি হয় তখন যখন ইমোনোগ্লোবিন-ই-এর পরিমাণ রক্তে বেড়ে যায়। যার ফলে অ্যালার্জেন অ্যান্টিবডির বিক্রিয়ার পরিমাণ বেশি হয় এবং এই বিক্রিয়ার ফলে নিঃসৃত হিস্টামিনের পরিমাপ বেশি হয় যা অ্যালার্জি সৃষ্টি করে। মোটকথা ধুলাবালি, ধোঁয়া, গাড়ির বিষাক্ত গ্যাস, কলকারখানার সৃষ্ট পদার্থ, বৃষ্টিতে ভেজা, শীতের কুয়াশা, ফুলের রেণু, বিশেষ কয়েকটি খাবার যেমন-চিংড়ি, ইলিশ, বোয়াল, গাজর, গরুর মাংস, হাঁসের ডিম, পাকা কলা, আনারস, নারিকেল, কসমেটিকস ও অগণিত জানা-অজানা জিনিস আমাদের শরীরে কাশি, শ্বাসকষ্ট অ্যালার্জি ও অ্যাজমার সৃষ্টি করতে পারে।

অ্যাজমা বা হাঁপানি :-
দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ এবং তার প্রতি সংবেদনশীলতাই অ্যাজমা বা হাঁপানি। এর উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয় হাঁচি, কাশি, বুকে চাপা ভাব, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণে বাধা।
হাঁপানির কারণ :-
বংশগত এবং পরিবেশগত কারণে হাঁপানি হলেও এ দুটি উৎপাদক কীভাবে সৃষ্টি করে তা পরিষ্কারভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রদাহের কারণে শ্বাসনালি লাল হয়, ফুলে যায়, সরু হয় এবং ইরিটেন্ট বা উদ্দীপকের গতি অতি সংবেদনশীল হয় যার ফলে হাঁপানির উপসর্গ দেখা যায়। নিম্নবর্ণিত বিভিন্ন উৎপাদকের (Triggers) কারণে হাঁপানির উপসর্গসমূহ সাধারণত দেখা যায়।
  • ইনফেকশন, সাধারণত ভাইরাসজনিত উপসর্গ যেমন- কোল্ড, ফ্লু ইত্যাদি।
  • অ্যালার্জেন, বিশেষত ধূলাবালি, পরাগরেণু, গৃহপালিত পশুপাখির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ ইত্যাদি।
  • ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম, বিশেষত শীতকালে।
  • আবেগ, যেমন-উত্তেজনা, ভয়, রাগ।
  • ইরিটেন্ট, প্রধানত বায়ুদূষণ।
  • ধূমপান (হাঁপানি রোগী নিজে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের ধূমপান পরিহার করতে হবে)।
  • আবহাওয়ার পরিবর্তন।
  • খাবার যেমন-কৃত্রিম রঙ এবং কিছু কিছু খাবার।
  • ওষুধ, যেমন-এসপিরিন ও অন্যান্য NSAIDs এবং বেটা ব্লকার।
হাঁপানির উপসর্গসমূহ :-
  • ঘড়ঘড় করে শব্দসহ শ্বাস-প্রশ্বাস
  • শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হওয়া
  • বুকে ব্যথা এবং
  • কাশি ইত্যাদি
  • হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সময় শ্বাসনালিতে নিম্নোক্ত পরিবর্তনগুলো দেখা যায়
  • শ্বাসনালি লাল ও ফুলে যাওয়ার ফলে সরু হয়।
  • শ্বাসনালির চারপাশের মাংসপেশিসমূহ সংকুচিত হয়ে শ্বাসনালিকে আরও সরু করে দেয়। শ্বাসনালিতে অধিক পরিমাণ শ্লেষ্মা তৈরি হয়ে শ্বাসনালিতে বায়ুপ্রবাহ আংশিকভাবে বন্ধ করে দেয়।
অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা :-
হাঁপানি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। সঠিক চিকিৎসা এবং ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে হাঁপানি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেসব উত্তেজনের (ট্রিগার) কারণে হাঁপানির তীব্রতা বেড়ে যায় রোগীকে সেগুলো শনাক্ত করতে হবে এবং পরিহার করতে হবে। এছাড়া সব হাঁপানি রোগীকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখতে হবে।
  • ধূমপান এবং তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে।
  • ঠান্ডা বাতাস হাঁপানির তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এই সময় ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে।
  • ব্যায়াম এবং শারীরিক পরিশ্রম নিরুৎসাহিত করা উচিত নয়। ব্যায়াম শরীর ভালো রাখে এবং উচ্চরক্তচাপ ও অন্যান্য জটিল রোগবালাই থেকে শরীরকে রক্ষা করে। সঠিক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যায়ামের সময় বা পরে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা পরিহার করা সম্ভব।
  • বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং বাড়িতে অবাধ বিশুদ্ধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
অ্যালোপ্যাথি ওষুধ :-
দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় যেমন-
(১) হাঁপানি প্রতিরোধক (২) হাঁপানি উপশমকারক
হাঁপানি প্রতিরোধক :-
যেসব ওষুধের ব্যবহার হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হওয়া প্রতিরোধ করে তাদের হাঁপানি প্রতিরোধক বলা হয়। দুপ্রকারের ওষুধ হাঁপানি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ওষুধসমূহ :-
এসব ওষুধ শ্বাসনালির প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হাঁপানি প্রতিরোধ করে। এই শ্রেণীর বহুল ব্যবহৃত বুসোনাইড, ক্লোমিথাসেন, ফ্লুটিকাসোন ইত্যাদি।
ব্রঙ্কোডাইলেটর বা শ্বাসনালি প্রসারক : এসব ওষুধসমূহ দ্রুত শ্বাসনালিকে প্রসারিত করে হাঁপানির তীব্রতা প্রতিরোধ করে।
হাঁপানি উপশমকারক :-
ব্রঙ্কোডাইলেটরসমূহ উপশমকারক হিসেবে কাজ করে। ব্রঙ্কোডাইলেটরসমূহ শ্বাসনালিকে দ্রুত প্রসারিত করে ফলে ফুসফুসে সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে এবং এর মাধ্যমে হাঁপানি আক্রান্ত রোগীর উপসর্গসমূহ দ্রুত উপশম হয়।
দু ধরনের ব্রঙ্কোডাইলেটর বা শ্বাসনালি প্রসারক আছে যেমন-
ক্ষণস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর যেমন-সালবিউটামল। এসব ওষুধ দিনে ৩-৪ বার ব্যবহার করতে হয়।
দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর যেমন-ব্যামবিউটামল। এসব ওষুধ দিনে একবার ব্যবহার করতে হয়। মৃদু বা মাঝারি হাঁপানিতে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষণস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর (যেমন-সালবিউটামল) ব্যবহার করলে কোনো ধরনের ক্লিনিক্যাল সুবিধা পাওয়া যায় না। তাই এসব ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর (যেমন-ব্যামবিউটামল) ব্যবহার করতে হবে।
রাত্রিকালীন হাঁপানিতে মোডিফাইড রিলিজড থিওফাইলিনের বিকল্প হিসেবে ব্যামবিউটামল ব্যবহার করে ভালো সুফল পাওয়া যায়।
হাঁপানির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া :-
  • অনেক রোগীই হাঁপানি চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলে কিন’ অনিয়ন্ত্রিত হাঁপানি আরও ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
  • সঠিক চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবহারের মাধ্যমে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ না করলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং অকেজো হবে।
  • শিশুদের হাঁপানির ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মায়েদের বেলায় গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
অ্যালোপ্যাথি  হাঁপানি চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া :-
করটিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার ওরাল ক্যানডিয়াসিস সৃষ্টি করতে পারে। যেসব রোগী ইনহেলারের মাধ্যমে করটিকোস্টেরয়েড ব্যবহার করে তাদের অস্টিওপেরোসিস প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট (যেমন-অসটোক্যাল/অসটোক্যাল জেআর) গ্রহণ করা উচিত।
থিয়োফাইলিন এবং এ জাতীয় ওষুধসমূহ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং রোগীকে অবসন্ন করে দেয় বলে থিয়োফাইলিনের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি ব্রঙ্কোডাইলেটর যেমন-ব্যামবিউটামল (ডাইলেটর) ব্যবহার করা উচিত।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা :-

হোমিওপ্যাথরা সাধারনত বেশ কিছু ঔষধের পাওয়ার এবং মাদার টিংচারের সমন্বয়ে চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন। তার মধ্যে হোমিওপ্যাথিক মাদার টিংচারসমূহ অতি দ্রুত ফলাফল প্রদান করে থাকে যা তাত্ক্ষণিক ভাবে শ্বাসকষ্ট দূর করতে কার্যকর ভুমিকা রাখে। সবচেয়ে বড় কথা হল হোমিওপ্যাথি হলো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন এক অনন্য চিকিৎসা বিজ্ঞান। তাই যে কেউ নিশ্চিত ভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অরজিনাল মেডিসিন ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *