এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, লিভার হলো আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় সলিড অর্গান। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে লিভারের ওজন হয়ে থাকে ১ থেকে ১.৫০ কেজি। এক কথায় বলতে গেলে লিভার হলো মানব দেহের একটি পাওয়ার স্টেশন। যেমন ধরুন—বিদ্যুতের বাতি জ্বলতে হলে পাওয়ার সাপ্লাই লাগে, তেমনি আমাদের সব ক’টি অঙ্গ চলাচলের জন্য শক্তির উত্স হলো এই লিভার।
আমরা যে সব খাবার খাই, এই যেমন—শর্করা, চর্বিজাতীয় পদার্থ, আমিষ, খনিজদ্রব্য ইত্যাদি সব ভেঙে একমাত্র লিভারই প্রক্রিয়াজাত করে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উপাদানগুলোকে শরীরের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে, নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে লিভার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সরবরাহ করে। সেজন্য আল্লাহপাক লিভারকে একটি বিরাট মহাবিস্ময়কর কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি হিসেবে সৃষ্টি করে পেটের মধ্যে স্থাপন করেছেন।
মানুষের রক্তের মধ্যে Coagulation Factors নামে প্রবাহিত অসংখ্য কেমিক্যালস রয়েছে, যা রক্তকে সঞ্চালিত রাখে। সব ক’টি Coagulation Factors শুধু লিভার থেকে তৈরি হয়। রক্তের সঞ্চালন এবং জমাট বাঁধার ক্ষমতা একমাত্র লিভারের কার্যক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।আমরা যা কিছু খাই, সেই খাবারগুলো পরিপাকতন্ত্রে প্রাথমিক হজমের জন্য পিত্তরস অপরিহার্য। পিত্তরস ছাড়া খাদ্যবস্তু হজম সম্ভব নয়। এই পিত্তরস শুধু লিভার কোষ তৈরি করে।
আপদকালীন ব্যবহারের জন্য ভিটামিন এ, ডি, ই-কে লিভারে জমা থাকে। তাছাড়া প্রয়োজনীয ঞত্ধপব ঊষবসবহঃ যেমন— আয়রন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি লিভারে জমা থাকে। মোট কথা, লিভার এতসব কাজ করে থাকে যা বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যায় না এবং এমন সব কাজ করে যা আমরা জানি না।
লিভারের যেসব অসুখ হয় :-
আমাদের দেশে লিভারের যে রোগগুলো হয়ে থাকে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো—
- ভাইরাল হেপাটাইটিস (যা জন্ডিস নামে পরিচিত)
- লিভার সিরোসিস
- লিভার ক্যান্সার
- লিভারের ফোঁড়া
- পিত্তথলির বা পিত্তনালীর রোগ
- লিভারের জন্মগত ও মেটাবলিক রোগ ইত্যাদি।
লিভারে অসুখের লক্ষণগুলো :-
উল্লেখযোগ্য, লিভারের অসুখের লক্ষণাদি সহসাই প্রকাশ পায় না, কারণ লিভারের ১১ ভাগের একভাগ অংশ যদি কারও ভালো থাকে, তবে লিভারের অসুখ প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সৃষ্টিকর্তা এত বিশাল পরিমাণ ক্ষমতা দিয়ে লিভার তৈরি করেছেন যে, খুব ক্ষতিগ্রস্ত না হলে লিভারের রোগ বোঝা যায় না। লিভারের অসুখ-বিসুখের মধ্যে প্রধানতম রোগ হলো—ভাইরাল হেপাটাইটিস যা সাধারণের মাঝে জন্ডিস নামে অধিক পরিচিত। আমাদের দেশে ঘরে ঘরে যে জন্ডিস দেখা যায় বা মহামারি আকারে যে জন্ডিস হয় তা একটি ভাইরাস পরিবার দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে।
এই ভাইরাস পরিবারকে নামকরণ করা হয়েছে— হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই। এই ভাইরাসগুলোকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন—ক. পানি ও খাদ্যবাহিত ভাইরাস, যথাক্রমে হেপাটাইটিস ‘এ’ ও হেপাটাইটিস ‘ই’ এবং খ. রক্ত কিংবা দূষিত সিরিঞ্জ সুচের মাধ্যমে বাহিত ভাইরাস, যথা—হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি।
দূষিত পানি কিংবা খাদ্যবস্তু গ্রহণের ২ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে হেপাটাইটিস এ এবং ই দ্বারা আক্রান্ত হলে লক্ষণ দেখা যায়। অপরদিকে হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগের লক্ষণ দূষিত রক্ত কিংবা সিরিঞ্জের মাধ্যমে রোগ সংক্রমিত হওয়ার ৪ থেকে ৬ মাসের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। রোগের লক্ষণ দিয়ে বোঝার উপায় নেই কোনো ভাইরাস দ্বারা জন্ডিস হয়েছে। জন্ডিসের অন্যতম লক্ষণ হলো—হঠাত্ করে বমিভাব, কিংবা তীব্র বমি হওয়া। খাদ্য গ্রহণে অরুচি, অনীহা কিংবা তীব্র দুর্বলতা, কখনও কখনও জ্বর জ্বর ভাব বা জ্বরের মাধ্যমেও রোগের সূত্রপাত হতে পারে।
এ অবস্থায় প্রশ্ন হলো, আপনি করবেন কী? আমাদের দেশে জন্ডিসের চিকিত্সা মহাবিভ্রাটে ঘোরপাক খাচ্ছে। কারণ জন্ডিস হয়েছে শুনলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই একেকটা পরামর্শ প্রদান করেন। সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রথম চিকিত্সা :-
ক. শরীরের পরিপূর্ণ বিশ্রাম এবং খ. স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া চালিয়ে যাওয়া।
অনেকে মনে করেন, জন্ডিস হয়েছে তাই এখন বেশি বেশি ফলের রস ও পানি খেতে হবে এবং হলুদ মরিচ খাওয়া যাবে না। এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমি বলব, জন্ডিস হলে রোগীকে হলুদ, মরিচ, তরিতরকারি, মাছ-মাংস ইত্যাদি স্বাভাবিক খাবার খেতে দিন। ফল, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি খাওয়াবেন না। ঘন ঘন গোসল করাবেন না। জনমনে আরও কুসংস্কার রয়েছে, যেমন— নাকে নস্যি দেয়া কিংবা লতাপাতা খাওয়ানো। এসব চিকিত্সার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। নাকে নস্যি দেয়ার ফলে অনেকে মারাত্মক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আমাদের কাছে আসেন। জন্ডিস হওয়ার ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে যদি রোগের লক্ষণ ভালো না হয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। জন্ডিস হওয়ার পর কেউ অস্থিরতা, অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা অজ্ঞান হলে, এটা মারাত্মক জরুরি অবস্থা। তাকে অনতিবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস :-
লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের ফলে যেসব রোগ হয়ে থাকে তাকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলে। বাংলাদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। রোগী প্রাথমিক অবস্থায় বুঝতেই পারেন না কখন তিনি বি অথবা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে কখনও কোনো কারণে রক্ত পরীক্ষা করলে হঠাত্ হেপাটাইটিস বি অথবা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ধরা পড়ে।
হেপাটাইটিস বি এবং সি সংক্রমণ মাসের পর মাস ধরে চলতে থাকলে আপনার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রথম পর্যায়ে সচেতন না হলে বোঝার কোনো উপায় নেই। লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হলে আস্তে আস্তে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন—দুর্বলতা, খাওয়ার প্রতি অনীহা, শরীরের ওজন কমে যাওয়া কিংবা জন্ডিস প্রকাশিত হওয়া। এরপরও যদি রোগী বুঝতে না পারেন তাহলে ক্রমান্বয়ে পেটে ও শরীরের অন্যান্য অংশে পানি আসবে। এ অবস্থায় লিভারের অবস্থা মারাত্মক হয়ে যায় এবং লিভার সিরোসিসে রূপ নেয়। সময় থাকতে চিকিত্সা শুরু করলে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিস প্রতিরোধ করা যায়।
লিভার ক্যান্সারের কারণ :-
আমাদের দেশে লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। এ দুটি ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রতিহত করলে লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। লিভার ক্যান্সার হওয়ার আগে সিরোসিস হয় এবং এই সিরোসিস প্রতিহত করতে পারলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রাথমিক অবস্থায় খুব ছোট আকারের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়লে তা প্রতিরোধ করা যায়। আর তা না হলে পরবর্তী সময়ে এটা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
লিভারের অসুখের জন্য আপনি কতটা দায়ী ?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হেপাটাইটিস ই এবং হেপাটাইটিস এ খাদ্যাভাসের জন্য হয়ে থাকে। যত্রতত্র বিক্রি হওয়া রাস্তার ধারের খোলা খাবার কিংবা আখের রস অথবা শরবত যারা খান তাদেরই এই জন্ডিস হয়। যারা শহর অঞ্চলে বসবাস করেন কিন্তু পানি না ফুটিয়ে পান করেন কিংবা গ্রামগঞ্জে টিউবওয়েলবিহীন স্থানে যারা ডোবা বা পুকুরের পানি পান করেন তারা হেপাটাইটিস এ বা ই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।
অন্যদিকে দূষিত সুচ কিংবা দূষিত রক্ত গ্রহণের ফলে অথবা ব্যক্তিগত ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের ফলে হেপাটাইটিস বি এবং সি জনিত লিভার রোগ হতে পারে। তাছাড়া যত্রতত্র খোলা খাবার গ্রহণের ফলে লিভারে ফোঁড়া (Liver Abscess) হতে পারে। মদ্যপান বা এলকোহল খেতে যারা অভ্যস্ত বা আসক্ত তাদের লিভারের রোগ অবশ্যম্ভাবী। যে কোনো ধরনের নেশা করলে লিভার আক্রান্ত হবেই।
লিভারের রোগের চিকিত্সা :-
এখানে উল্লেখ করতে চাই, জনগণের অনেক সংশয় রয়েছে লিভারের কঠিন রোগের চিকিত্সা বাংলাদেশে হবে হবে কি না? আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই এবং সবাইকে জানাতে চাই, বাংলাদেশে বর্তমানে হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগ নির্ণয়, চিকিত্সার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং অভিজ্ঞ চিকিত্সক সবই আছেন। এজন্য অযথা হয়রানি হবেন না। লিভারের যেকোন জটিল অবস্থায় হোমিওপ্যাথি কার্যকর ভুমিকা পালন করে। জন্ডিস, HBsAg (+ve), লিভারে ফোঁড়া, লিভার ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস এর মত মারাত্মক সব জটিল রোগের সফল চিকিত্সা করা সহ এ সমস্ত সমস্যা সমূহকে সাফল্যের সাথে সারিয়ে তুলছেন দেশের খ্যাতনামা হোমিওপ্যাথরা। পাঠকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, প্রাথমিক অবস্থায় এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি না করে প্রথমেই হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সা গ্রহণ করুন তাহলে খুব দ্রুত ভালো হবেন।
লিভার রোগ থেকে মুক্তির উপায় :-
- আমাদের দেশে যেসব লিভার রোগ হয় তার বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য, যেমন—হেপাটাইটিস এ এবং ই। যেখানে-সেখানে খোলা খাবার গ্রহণের অভ্যাস ত্যাগ করলেই এই দুটি রোগ হবে না।
- হেপাটাইটিস এ রোগের টিকা এখন আমাদের দেশে পাওয়া যায়। তাই শিশুদের হেপাটাইটিস এ টিকা দিতে ভুলবেন না।
- প্রাণঘাতী রোগ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা সর্বত্র পাওয়া যায়। তাই সব বয়সের মানুষের এ টিকা অবশ্যই নেয়া উচিত। পরিবারের কোনো সদস্যের হেপাটাইটিস বি হলে অন্য সবাইকে প্রতিষেধক টিকা নেয়া জরুরি।
- হেপাটাইটিস সি-এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয়নি। তাই সাবধানতাই বর্তমানে এ রোগ থেকে বাঁচার উপায়।
- রক্ত গ্রহণের আগে পরীক্ষা করে নিতে হবে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি মুক্ত কিনা।
- ইনজেকশন নেয়ার সময় দূষিত সুঁই ব্যবহার করবেন না।
- সব ঝুঁকিপূর্ণ ও অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক বা আচরণ পরিহার করুন। লিভার সুস্থ রাখতে আপনার সচেতনতাই হতে পারে অন্যতম পন্থা।