ক্রমেই বাড়ছে স্তন ক্যান্সার৷ বাংলাদেশ এবং ভারত কোনটাই ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু এ নিয়ে সচেতনতা এখনও তলানিতে৷ বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম৷ জেন-এক্স কলেজ পড়ুয়ারা যতই মজে থাকুক হলিউডে, জিনপরীক্ষায় বিপদের আঁচ পেয়ে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ম্যাস্টেকটোমি করানোর প্রভাব বাস্তব জীবনে সবক শেখাতে পারেনি মহানগরের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের৷ দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে যাদের চলাফেরা সিংহভাগ ছাত্রীদের ধারণাই নেই স্তন ক্যান্সার নিয়ে রয়েছে ঠিক কতটা বিপদের হাতছানি৷
অথচ বয়স ২০ পেরোলেই জিনপরীক্ষা (বিআরসিএ-১ ও ২) করে স্তন ক্যান্সারের আগাম আঁচ পাওয়া সম্ভব (যেমনটা করেছিলেন জোলি)৷ ছাত্রীরা অবশ্য জানে না সে কথা৷
ধূমপান যে স্তন ক্যান্সারের জন্য বাড়তি ঝুঁকি, তা কি জানা আছে? উত্তর- না৷উল্টো, উঠতি বয়সে নারী স্বাধীনতারই যেন নয়া দিশারি এই কিংসাইজ সিগারেট৷ আর ছেলেরা? পুরুষেরও যে স্তন ক্যান্সার হতে পারে, এ কথা জানা ছাত্রের সংখ্যা আক্ষরিক অর্থেই হাতেগোনা৷
সেলফ ব্রেস্ট এগজামিনেশনই যে স্তন ক্যান্সার ঠেকানোর সেরা রাস্তা, তা নিয়েও তেমন ধারণা গড়ে ওঠেনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের মনে৷ এমনকি, মা-বোনদের সঙ্গেও এ মারণরোগের আশঙ্কা নিয়ে খোলামনে আলোচনা করতে পারে না অধিকাংশই৷ এ নিয়ে উত্সাহও যে আছে, তা-ও অবশ্য নয়৷
রোগ সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক ধারণা আছে বটে৷ কিন্ত্ত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এখনও এ সব ‘আধুনিকা’র অন্তরমহলে রয়ে গিয়েছে হয় অনীহা অথবা কুণ্ঠা৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্সের তিন ছাত্রী দেয়াশিনি বিশ্বাস, নাদিয়া ইমাম ও রোহিনী মিত্র এ বছরই পা রেখেছে ক্যাম্পাসে৷ এদের সকলেরই বক্তব্য, ব্রেস্ট ক্যানসার যে তাঁদের হতে পারে, এমন একটা ভাবনা তাঁদের মাথা থেকে আলোকবর্ষের দূরত্বে৷
‘যা শোনা যায়, তাতে চল্লিশের কাছাকাছি গিয়ে এই ধরনের ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ে৷ তাই আঠেরোতেই এই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মতো কী আছে?’– পাল্টা প্রশ্ন নাদিয়ার৷ দেয়াশিনির কথায়, ‘আমি কিছুটা হলেও জানি৷ কারণ আমার মা নিয়মিত চেক আপ করান৷ কিন্তু তাঁর তো বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে৷’
ইংরেজি স্নাতকোত্তরের ছাত্রী কথাকলি বিশ্বাস ও দেবারতি রায়দের দাবি, তাঁরা এ রোগটা সম্পর্কে জানেন৷ দেবারতির কথায়, ‘শুনেছি, স্তন ক্যানসার ঠেকাতে সঠিক ভাবে অন্তর্বাস পরা খুব জরুরি৷’ কথাকলির বলছেন, ‘এখন অনেক নতুন মায়েরা স্তনের আকার খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাচ্চাকে খুব কম দিন স্তন্যপান করান৷ সেটাও খারাপ৷’ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর অর্থনীতির প্রথম বর্ষের ছাত্রী অন্তরা মণ্ডলের কথায়, ‘বাড়িতে তো এই নিয়ে আলোচনা বিশেষ হয় না৷ মায়ের সঙ্গেও না৷ আর বন্ধুরা তো বেশি জানেই না৷ যেটুকু জানি, কাগজ পড়ে৷ তবে ভয় লাগে৷’ তাঁর কথায়, ‘শুনেছি ধূমপান করলে এই প্রবণতা বাড়ে৷ আমি করি না৷ কিন্ত্ত আমরা সবাই তো প্যাসিভ স্মোকার৷ তাই বিপদটা থেকেই যাচ্ছে৷’
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী সুপ্রিয়া সরকার, সুজাতা শর্মা এবং রাখি দলুই৷ এদের সকলেরই বক্তব্য, নিয়মিত চেক-আপ করানোর ইচ্ছে থাকলেও বাড়িতে বলা সম্ভব নয়৷ কারণ বাড়িতে এ নিয়ে কারও সঙ্গেই খোলাখুলি আলোচনা হয় না৷ ওঁদের বাড়ির লোকজন মনে করেন, এ সব নিয়ে জানার বয়স ওদের হয়ইনি!
প্রেসিডেন্সির রাষ্ট্রনীতি বিভাগের ছাত্রী মেহেক চক্রবর্তীর কথায়, ‘ব্রেস্ট চেক-আপ করাতে পারি৷ কিন্ত মহিলা চিকিত্সক ছাড়া একটু সমস্যা হবে৷ তবে ঠিকঠাক অর্ন্তবাস পরা এর জন্য খুব জরুরি বলে শুনেছি৷’ একই সুর তাঁর সহপাঠী পৃথা রায়ের গলাতেও৷ ইতিহাসের ছাত্রী ময়ূরী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌমী দত্ত জানাচ্ছেন, তাঁরা সেলফ ব্রেস্ট এগজামিনেশন করেন৷ নিয়মিত নিজেরাই আয়নায় দেখে নেন, স্তনের কোনও অংশ শক্ত ঠেকছে কিনা৷ কিন্ত্ত তাঁদেরও যুক্তি, ‘ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য লেডি ডক্টর ইজ মাস্ট৷’ সৌমির অভিজ্ঞতা, ‘একবার ইসিজি করতে গিয়ে জামা খুলতে খুব অস্বস্তি হয়েছিল৷ তাই পুরুষ চিকিত্সক আর নৈব নৈব চ৷’ তিনিও মনে করেন সঠিক অন্তর্বাসের তত্ত্বে৷
চিকিত্সকরা অবশ্য নস্যাত্ করছেন বিষয়টি৷ এসএসকেএমের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক চিকিত্সক দীপেন্দ্র বিশ্বাস জানাচ্ছেন, অর্ন্তবাসের সঙ্গে স্তন ক্যানসারের কোনও সম্পর্ক নেই৷ তাঁর কথায়, ‘দামি বা ব্র্যান্ডেড ব্রা পরলেই স্তন ক্যানসার থেকে মুক্তি মিলবে, এমনটা নয়৷’ তাঁর বক্তব্য, একমাত্র সচেতনতাই পারে এ রোগ থেকে নিষ্কৃতি দিতে৷ কিন্তু আক্ষেপ, সেটাই একেবারে আশানুরূপ নয় নতুন প্রজন্মের মধ্যে৷
কোন কোন ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার হতে পারে?
- ঋতুচক্র যাঁদের তাড়াতাড়ি শুরু এবং দেরিতে শেষ হয়েছে
- ৩০ বছরের বেশি বয়সে যাঁরা প্রথমবার মা হয়েছেন
- হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাচ্ছেন যাঁরা
- বাচ্চাকে স্তন্যপান না-করানো অথবা নিঃসন্তান মহিলাদের
- স্থূলতা বা ওবেসিটি
- নিয়মিত ধূমপান ও মদ্যপান করা
- জিনঘটিত কারণ
কী করে বুঝবেন ?
স্তনের কোনও অংশ ফোলা, অথচ ব্যথা নেই৷ বৃন্ত থেকে রক্তপাত৷ স্তনের ত্বক কিংবা বৃন্ত কুঁচকে যাওয়া
কি করবেন ?
তাড়াতাড়ি ধরা না-পড়লে, রোগনির্ণয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই মারা যান ৪০ শতাংশ রোগী৷ আর পাঁচটা ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার (মেটাস্টেসিস) সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের ছড়িয়ে পড়া মেলে না৷ একাধিক জিন এর নেপথ্যে থাকায় আঁচ পাওয়া মুশকিল, কখন কোন রোগিণীর ক্ষেত্রে ক্যান্সার কেমন চেহারা নেবে৷ হয়তো ৫ সেমি টিউমার বাড়লোই না, আবার ১ সেমি টিউমার ছ’মাসে বেড়ে দাঁড়াল ১৫ সেমি-তে। তবে সঠিক সময়ে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত কোনো রোগীনি যদি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার আওতায় আসেন তাহলে এর থেকে রেহাই পাওয়া যায় খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু অন্যান্য রোগের মত স্তন ক্যানসারকেও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা উচিত আর আক্রান্ত হলে হোমিওপ্যাথিই হতে পারে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন ও সফল চিকিৎসা।