অনিদ্রা রোগ নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রয়োগ সংকেত নিয়ে আজকের নিবন্ধ।

শুনে আশ্চর্য হবেন, আমাদের দেশের মোট প্রাপ্ত বয়স্কের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই ঘুম বিভ্রাটের শিকার। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। এরা ঠিকমত কোনো কাজে মনঃসংযোগ করতে পারছেন না, ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, নানা অসুখে-বিসুখে ভূগছেন। ঘুম বিভ্রাটের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় অনিদ্রা বা নিদ্রাহীনতার কথা। অনিদ্রা মানে না ঘুমিয়ে থাকা।
কিন্তু পুরোপুরি না ঘুমিয়ে তো বাঁচা সম্ভব নয়। আসলে ঘুম ঠিকমত না হলে বা কম হলে তাকেই আমরা বলি অনিদ্রা রোগ। অথচ অনেকেই বলতে শুনবেন, কাল দু’চোখের পাতা এক করতেই পারিনি। এরা কিন্তু ঠিক কথা বলেন না। ঘুম কম হওয়া যেমন একটা অসুখ, তেমনি বেশি ঘুমনোও কিন্তু অসুখ যাকে বলা হয় নার্কোলেপসি। আবার প্লি অ্যাপনিয়া নামে আরেক ধরনের ঘুম বিভ্রাটও দেখা যায় অনেকের মধ্যে। এবার এদের নিয়ে আলোচনা করি। ইনসমনিয়া: ল্যাটিন শব্দ ‘সমনাস’-এর অর্থ ‘প্লি ’ বা ‘ঘুম’, আর ‘ইন’-এর অর্থ ‘নট’ বা ‘না’। দুয়ে মিলে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা।
নানা ধরনের শ্রেণী বিভাগ রয়েছে ইনসমনিয়ার। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই শ্রেণী বিভাগ করেছেন। যেমন, প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ইনসমনিয়া। প্রাইমারি হয় বংশগত কারণে আর সেকেন্ডারি হয় নানা মানসিক ও শারীরিক কারণে। আবার এক্সোজেনাস ও এন্ডোজেনাস, এই দু’ভাবেও ইনসমনিয়াকে ভাগ করা হয়ে থাকে। অনেকে অ্যাকিউট এবং ক্রনিক, এভাবেও বলেন। তবে ঘুম বিভ্রাটের ধরন অনুযায়ী তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে একে।
১) ইনিশিয়াল ইনসমনিয়া: ঘুম আসি আসি করেও আসতে চায় না। কেই বারে বারে উঠে জল খান, ছোট বাথরুমে যান, কোল বালিশ নিয়ে এপাশ-ওপাশ করেন, বিছানার চাদর-বালিশ ঠিকটাক করেন। এমন করতে করতেই হঠাৎ করেই তারা ঘুমিয়ে পড়েন।
২) মিডল বা ইন্টারমিটেন্ট: বারে বারে ঘুম ভাঙ্গে। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হয়। স্নায়ুবিক উত্তেজনাই এর কারণ।
৩) টার্মিনাল ইনসমনিয়া: শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। একবার ভেঙ্গে গেলে আর আসতে চায় না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরই এই সমস্যা বেশি। এদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মহিলা এবং ৩০ শতাংশ পুরুষ। নার্কোলেল্পি: কম ঘুমানোর মত বেশি ঘুমানো এবং যেখানে সেখানে যখন তখন ঘুমিয়ে পড়াটা এক ভয়ংকর অসুখ।
৫৮ বছর বয়সী আমেরিকান আইনজীবী বব ক্লাউড কোর্টে সওয়াল করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়তেন। এই রোগীদের ক্যাটাপ্লেক্সি নামে একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত আবেগ, উত্তেজনা, পরিশ্রমে এরা সাময়িক পক্ষাঘাতগ্রস্থ হন, জ্ঞান হারান না কিন্তু আচ্ছন্নভাব নিয়ে পড়ে থাকেন। নার্কোলেল্পি জিনের ত্রুটিজনিত রোগ। তবে লাইফস্টাইল পাল্টে এবং হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগে এ ধরনের রোগীকে ভাল রাখা যায়।
প্যারাসমনিয়া :- ঘুমের দুটো পর্বের কথা আগেই বলেছি। এই ধরনের রোগীদের বেলায় এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে যাওয়ার যে সহজ গতিছন্দ তাতে ব্যাঘাত ঘটে। ঘুম থেকে ওঠার পরে তারা মোটেও চনমনে, স্বাভাবিক থাকেন না। ঘুমের মধ্যে হাঁটা, কথা বলা, দাঁত কিড়মিড় করা, কেঁদে ওঠা, দুঃস্বপ্ন দেখা, মূত্রত্যাগ করা, নাক ডাকা, শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গ দেখা যায় এই ধরনের রোগীদের মধ্যে।
প্লি অ্যাপনিয়া :- ঘুমের মধ্যে রোগীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, মনে হয় কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে, হঠাৎ করে রোগী ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠে। এই রোগীরা প্রচন্ড নাক ডাকে। বারে বারে প্লি অ্যাপনিয়া হলে রোগীর ব্রেন ও হার্ট কম অক্সিজেন পায়, এর ফলে মৃত্যুও হতে পারে। এই ধরনের রোগীরা যেহেতু রাতে এক টানা ঘুমোতে পারে না, সে জন্য সারাদিন এরা ঝিমোয়, হাই তোলে, ক্লান্তি অবসাদে ডুবে থাকে, মাথাব্যথায় ভোগে। পরবর্তীকালে এদের হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। এই সব উপসর্গকে একসঙ্গে বলে অবস্ট্রাকটিভ প্লি অ্যাপনিয়া সিন্ড্রোম বা ওএসএএস। ৬ ঘন্টার ঘুমে বার তিরিশেক অ্যাপনিয়া হলে এবং অ্যাপনিয়াগুলো ১০ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হলে আমরা বলি অমুক প্লি অ্যাপনিয়ার রোগী।
এই অসুখের দুটো পর্যায় আছে। প্রথমটি হল অবস্ট্রাক্টিভ প্লি অ্যাপনিয়া এবং দ্বিতীয় সেন্ট্রাল প্লি অ্যাপনিয়া। প্রথমটির বেলায় শ্বাসপথের কোথায় অবস্ট্রাকশন বা অবরোধ আছে, সেটি নির্ণয় করে সেই মত চিকিৎসা করাতে হয়। সেন্ট্রাল প্লি অ্যাপনিয়ার ত্রুটি থাকে মস্তিস্কে, চিকিৎসা না করালে রোগী মারা যেতে পারে। অ্যাপনিক রোগীদের ওজন কমাতে হবে, মদ্যপানসহ সব ধরনের নেশা ছেড়ে দিতে হবে। রেস্টলেস লেগ সিন্ডোম: এও এক ধরনের ঘুম বিভ্রাট। ঘুমের মধ্যে রোগীর পায়ে পিন ফোঁটানোর মত যন্ত্রণা হওয়ার জন্য রোগী পা ছেড়ে, এপাশ-ওপাশ করে।
হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান :-
অনিদ্রা রোগ নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রয়োগ সংকেত অত্যন্ত কার্যকর। নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধ সেবনে এই রোগ নিরাময় করা সম্ভব কারণ হোমিওপ্যাথিতে একই রোগে লক্ষণভেদে ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এখানে রোগের নামের চেয়েও লক্ষণের গুরুত্ব বেশি।


Leave a Reply